ইয়াছিন আরাফাত :
প্রজন্ম হোক সমতার- সকল নারীর সমধিকার’ এ শ্লোগানকে সামনে রেখে দেবীদ্বারে পালিত হয়েছে আন্তর্জাতিক নারী দিবস। নারীর মর্যাদা ও সমঅধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম জোরদার করার আহ্বান জানিয়েছেন আয়োজকরা।
আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনা সমাবেশে নেতৃবৃন্দ বলেন, সারা দেশে নারী ও কন্যা শিশু হত্যা, ধর্ষণ, ফতোয়া, যৌতুক, উত্ত্যক্তকরণসহ ঘরে-বাইরে সর্বত্র সকল প্রকার নারী নির্যাতন রুখে দাঁড়াতে হবে। ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ডের বিধান করতে হবে।
রবিবার সকালে দেবীদ্বার উপজেলা প্রশাসন, মহিলা বিষয়ক দপ্তর ও জাতীয় মহিলা সংস্থার উদ্যোগে আয়োজিত আলোচনা সভায় উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা সালমা ইয়াসমিনের সভাপতিত্বে এবং আবেদা মান্নান ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক মোঃ মোরশেদ আলম ভূঁইয়ার সঞ্চালনায় প্রধান অতিথি ছিলেন উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আলহাজ¦ মোঃ জয়নুল আবেদীন। বিশেষ অতিথি ছিলেন, উপজেলা সহকারী কমিশনার শাহিদা আক্তার, জেলা পরিষদ সদস্য শিরিন সুলতানা, উপজেলা পরিষদ ভাইস চেয়ারম্যান এডভোকেট নাজমা বেগম, নারী নেত্রী হাসিনা আবেদীন।
আলোচনা সভার আগে বিভিন্ন পিঠা, বস্ত্র ও অন্যান্য ২০ দোকানের পর্ষদ মেলা ছাড়াও ফ্রি স্বাস্থ্য সেবায় ক্যাম্প করা হয়। পরে বিজয়ীদের পুরস্কার দেয়া হয়।
৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস। নারীর সমঅধিকার, মর্যাদা এবং অসম শ্রম মজুরির প্রতিবাদের ক্ষেত্রে দিনটির তাৎপর্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। সারা বিশ্বব্যাপী নারীরা একটি প্রধান উপলক্ষ হিসেবে এই দিবস উদযাপন করে থাকেন। কিন্তু নারী দিবস নিছক কোন দিবস নয়। স্বতস্ফুর্তভাবে এই দিবসটির উদয় হয় নি। এই দিবসটি উদযাপনের পেছনে রয়েছে নারী শ্রমিকের অধিকার আদায়ের সংগ্রামের ইতিহাস। বহু ত্যাগের মধ্য দিয়ে এই দিবস অর্জিত হয়েছে। এই দিবসটি সৃষ্টির পেছনে সমাজতন্ত্রের লড়াই মূখ্য ভূমিকা পালন করেছে।
১৮৫৭ সালে কর্মজীবী নারীদের শিল্প-কারখানায় শ্রম সময় কমিয়ে আনা, শ্রম মজুরির ক্ষেত্রে বৈষম্য দূরীকরণসহ আরও নানাবিধ স্বাধীনতা প্রদানকে কেন্দ্র করে নারী শ্রমিকরা রাজপথে নেমে আসে। তীব্র এই আন্দোলনের সূচনা হয় নিউইয়র্কের সুতা কারখানার অসংখ্য নারী শ্রমিকদের সংগঠিত শক্তির মাধ্যমে। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের রাস্তায় নেমেছিলেন। সেই মিছিল দেখে ভীতসন্ত্রস্থ হয়ে পড়ে শাসক শ্রেনী। সেই মিছিলে সরকারের লেঠেল বাহিনী দমন-পীড়ন চালায়। এরপরও থেমে থাকেনি সংগ্রাম। সেই ধারাবাহিকতায় ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে নিউইয়র্কের সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট নারী সংগঠনের পক্ষ থেকে আয়োাজিত নারী সমাবেশে জার্মান সমাজতান্ত্রিক নেত্রী ক্লারা জেটকিনের নেতৃত্বে সর্বপ্রথম আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন হলো।
ক্লারা ছিলেন জার্মান রাজনীতিবিদ; জার্মান কমিউনিস্ট পার্টির স্থপতিদের একজন। ১৯০৯ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি, আমেরিকার সমাজতান্ত্রিক পার্টির পক্ষ থেকেও নারী দিবস পালন করা হয়। এরপর ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন। মূলত এই নারী সম্মেলনের মধ্য দিয়েই নারী দিবস পালনের সম্মিলিত সিদ্ধান্ত গৃহিত হয়। ১৭টি দেশ থেকে আগত ১০০ জন নারী প্রতিনিধি এই সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন। এ সম্মেলনে ক্লারা জেটকিন প্রতি বছরের ৮ই মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালন করার প্রস্তাব দেন। তার প্রস্তাাবের প্রেক্ষিতে সিদ্ধান্ত হয় যে পরের বছর মানে ১৯১১ সাল থেকেই নারীদের সম-অধিকার দিবস হিসেবে দিনটি পালিত হবে। দিবসটি পালনে এগিয়ে আসে বিভিন্ন দেশের সমাজতন্ত্রীরা।
১৯১৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে বেশ কয়েকটি দেশে ৮মার্চ পালিত হতে লাগল। বাংলাদেশেও ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে স্বাধীনতার লাভের পূর্ব থেকেই এই দিবসটি পালিত হতে শুরু করে। অতঃপর ১৯৭৫ সালে ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি প্রদান করা হয়।
আজ আন্তর্জাতিক নারী দিবস সারা বিশ্বেই সরকারি-বেসরকারি নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে পালিত হচ্ছে। পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থা নারী দিবসকেও লুফে নিয়েছে। কিন্তু আজো নারী দিবসের চেতনা বাস্তবায়িত হয়নি। নারী নির্যাতন, খুন, ধর্ষণ একদিকে বাড়ছে, অন্যদিকে কর্মজীবী নারীদের মজুরি বৈষম্য প্রকটভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। সুতরাং নারী দিবসের প্রকৃত চেতনাকে বাস্তবায়ন করতে গেলে কর্পোরেট পুঁজিবাদের বিপরীতে সমাজতন্ত্রের সংগ্রামকে অগ্রসর করতে হবে। আসুন নারীমুক্তির সংগ্রামকে বেগবান করি।
সমাবেশে বক্তারা আরো বলেন, নারী দিবস ঘোষণার ১০৯ বছর পরেও দেশের নারীরা রাষ্ট্রীয়ভাবেই আইনি বৈষম্যের শিকার। এখনও সম্পত্তির উত্তরাধিকারে নারীর সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা পায়নি। ‘সমকাজে সমমজুরি’ আইনে থাকলেও, অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের নারী শ্রমিকদের ক্ষেত্রে তার বাস্তবায়ন নেই। পোশাক কারখানায় ৮০ শতাংশ নারী শ্রমিক যৌন নিপীড়নের শিকার হন। তাদের মজুরীও পৃথিবীর মধ্যে সর্বনিন্ম। নারীরা সারাদিন গৃহস্থালির কাজ করলেও তাদের শ্রমের স্বীকৃতি মেলেনি।
তারা আরো বলেন, সারা দেশে নারী-শিশু নির্যাতন-ধর্ষণ-হত্যা বেড়েই চলেছে। প্রতিদিন পত্রিকা খুললেই খুন-ধর্ষণ-অপহরণ-নির্যাতনের ঘটনা। একটি নির্যাতনের ঘটনা বিভৎসতায়, বর্বরতায় আগেরটিকে ছাপিয়ে যাচ্ছে। এই অবস্থার পরিবর্তনে নতুন মানবিক সমাজ-রাষ্ট্র গড়ে তোলার আহ্বান জানান তারা।