রবিউল আলম, গাজীপুর থেকে :
জামাল মিয়া (৪৩), টঙ্গী পাগার জিনু মার্কেট এলাকার আব্দুল হাকিম মিয়ার ভাড়াবাসায় পরিবার নিয়ে বসবাস করতো গতবছরের ডিসেম্বর মাসের ২৭ তারিখ পর্যন্ত। ওই দিন দুপুরে নামাজ পড়ার প্রস্তুতিকালে হঠাৎ হার্ট অ্যাটাক করেন তিনি। স্ত্রী ও প্রতিবেশীর সহযোগিতায় দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে আসেন জামালকে, কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহার হাসপাতাল এলাকায় পৌঁছাতে পারলেও এর প্রধান ফটকে গড়ে ওঠা অবৈধ সিএনজি-ইজিবাইকের স্ট্যান্ডের জটলার কারণে দ্রুত সময়ে জরুরি বিভাগে পৌঁছাতে না পেরে হাসপাতালের প্রধান ফটকেই নিস্তেজ হয়ে যায় জামাল মিয়ার দেহ। বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর জরুরি বিভাগে ঢুকলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। সেদিন ৩০ মিনিটের ইজিবাইক ও সিএনজি জটলার কারণে নিভে যায় জামাল মিয়ার জীবন প্রদীপ। অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে স্ত্রী রুমেলা বেগমের ভবিষ্যৎ।
এলাকাবাসী জানান, টঙ্গীতে প্রায় অর্ধকোটি মানুষের বসবাস। এই বিপুল জনগোষ্ঠীর চিকিৎসার অন্যতম ভরসাস্থল টঙ্গী শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার জেনারেল হাসপাতাল। হাসপাতাল সংলগ্ন ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক হওয়ায় জরুরি প্রয়োজনে স্বজনরা দ্রুত এই হাসপাতালে তাদের রোগী নিয়ে আসেন। কিন্তু অবৈধভাবে গড়ে ওঠা এই সিএনজি-অটোরিকশা স্ট্যান্ডের কারণে প্রায় সময়ই এখানে জটলা লেগে থাকে। এতে হাসপাতালে সেবা নিতে আসা রোগী ও তাদের স্বজনদের পড়তে হয় চরম ভোগান্তিতে।
হাসপাতালে সূত্রে জানা যায়, প্রতিদিন গড়ে টঙ্গীর শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসে এক থেকে দেড় হাজার রোগী। শুধু টঙ্গীই নয়, উত্তর, তুরাগ, গাছাসহ ৬টি থানার মানুষও জরুরি স্বাস্থ্যসেবায় এই হাসপাতালের ওপর আস্থা রেখে এখানে চিকিৎসা নিতে আসেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কয়েকজন কর্মকর্তা স্বীকার করেন, অবৈধ এই স্ট্যান্ডের জন্য প্রতিনিয়ত চরম ভোগান্তির শিকার রোগীরা। এমনকি মানুষের আস্থার প্রতীক এই হাসপাতালটিও নানা সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার জেনারেল হাসপাতালের সামনের সড়কে রিকশা, অটোরিকশা, ব্যাটারিচালিত রিকশা, ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান, প্রাইভেট কার, মাইক্রোবাস, অ্যাম্বুলেন্সসহ বিভিন্ন রকমের যানবাহন এ সড়কে চলাচল করে। হাসপাতালের সামনে যাত্রী ওঠানামা করে আবার বিভিন্ন যানবাহনের চালক যাত্রী পাওয়ার আশায় দীর্ঘ সময় যানবাহন দাঁড় করিয়ে রাখেন। হাসপাতালে প্রধান ফটকের সামনের স্থানীয় প্রভাবশালী মহলের নির্দেশে গড়ে উঠা অবৈধ সিএনজি স্ট্যান্ডের জটলার কারণে প্রায়ই গুরুতর রোগীদের নিয়ে যাতায়াতে বেগ পেতে হয় । বিভিন্ন সময়ে হাসপাতালে অস্থায়ীভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত নিরাপত্তা কর্মীরা এসব যানবাহন সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলেও কার্যত তাদের চেষ্টা ব্যর্থ হয়। যানজট নিরসনে কার্যকর কোনো উদ্যোগও কারো নজরে পড়ে না।
সেবা নিতে আসা রোগীর স্বজনরা জানান, অনেক সময় গুরুতর অবস্থায় রোগীকে ঢাকায় উন্নত চিকিৎসার জন্য পাঠানো হয়। তখনও হাসপাতাল থেকে রোগী বের করে অ্যাম্বুলেন্সে তোলার পর দেখা গেছে দীর্ঘ সময় হাসপাতালের গেইটের সামনেই যানজটে আটকে থাকতে হয়। এসব কারণে সময়মতো রোগী যথাযথ চিকিৎসা না পাওয়ায় তাঁদের মৃত্যুর ঝুঁকিও বেড়ে যায়।
হাসপাতালের বহির্বিভাগে সেবা নিতে আসা টঙ্গীর আউচপাড়া এলাকার ফজলুল হক বলেন, হাসপাতালের সামনের সড়কে বিভিন্ন ধরনের যানবাহন এলোমেলো দাঁড়িয়ে থাকে। এ জন্য ওই দুই জায়গাকে কেন্দ্র করে আশপাশে সড়কে দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে হাসপাতালের সামনে এসে যানজটে চরম দুর্ভোগে পড়তে হয়।
অনুসন্ধানে জানা যায়, হাসপাতালের প্রধান ফটকে গড়ে উঠা ওই স্ট্যান্ডে প্রায় ৫০ থেকে ৭০টি সিএনজি-অটোরিকশা দাঁড়িয়ে থাকে। এসব সিএনজি থেকে প্রতিদিন তোলা হয় টাকা। টঙ্গী থেকে ঘোড়াশাল লাইনে সিএনজি চালাতে এককালীন দিতে হয় ৩ থেকে ৫ হাজার টাকা। এছাড়াও প্রতিদিন দিতে হয় ১০০ টাকা করে জিপি।
হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, প্রতিদিন জরুরি বিভাগ ও বহির্বিভাগে গড়ে এক থেকে দেড় হাজার রোগী আসে চিকিৎসা নিতে। এত বিপুলসংখ্যক রোগীর চিকিৎসাসেবা দিতে প্রতিনিয়তই হিমশিম খেতে হয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে। এ অবস্থায় প্রধান ফটকের সামনে যদি দীর্ঘ সময় যানবাহনের জটলায় আটকে থাকতে হয়। তাহলে ভোগান্তি বেড়ে যায় কয়েক গুণ। এ বিষয়ে একাধিকবার প্রশাসনকে জানানো হলেও তাদের পক্ষ থেকে কার্যকরী তেমন কোনো সমাধান মেলেনি। তিনি আরো বলেন, প্রশাসনের হস্তক্ষেপে বেশ কয়েকবার উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করা হলেও কিছুদিন পর সেই পুরনো রূপ ফিরে পায় হাসপাতাল ফটক।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে গাজীপুর মহানগর পুলিশের (জিএমপি) উপকমিশনার ট্রাফিক (ডিসি, ট্রাফিক) আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, টঙ্গী-সিলেট মহাসড়কটি ব্যস্ততম একটি সড়ক। এসড়কের পাশেই ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট সরকারি হাসপাতাল। তাই সড়কের এমন ব্যস্ততম জায়গায় অবৈধ স্ট্যান্ড থাকতে পারে না। দ্রুততম সময়ের মধ্যে এই অবৈধ স্ট্যান্ড উচ্ছেদে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।