
এম শাহীন আলম :
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে নতুন মেরুকরণ স্পষ্ট হয়ে উঠছে, তা বিএনপির জন্য নিঃসন্দেহে এক কঠিন পরীক্ষার ইঙ্গিত দিচ্ছে। জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্বে এনসিপি, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ও এবি পার্টিসহ একাধিক ইসলামী ও সমমনা দলের সমন্বয়ে গঠিত নতুন রাজনৈতিক জোট আগামী নির্বাচনের হিসাব-নিকাশ আমূল বদলে দিতে পারে।
জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমানের নেতৃত্বে এই জোটে বর্তমানে ১০টি দল যুক্ত হয়েছে এবং আরও কয়েকটি দল, বিশেষ করে বিএনপির প্রতিষ্ঠাকালীন নেতা কর্ণেল অলি আহমেদের সম্ভাব্য যোগদানের বিষয়টি রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচিত হচ্ছে। যদি তা বাস্তবায়িত হয়, তবে এই জোটটি ১৩ দলীয় শক্তিশালী এক নির্বাচনী জোটে রূপ নেবে—যা বিএনপির জন্য নতুন বাস্তবতা তৈরি করবে।
এবারের নির্বাচনে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন হলো—রাজনীতির প্রচলিত ‘ইসলামপন্থী বনাম সেক্যুলার’ বিভাজন আর কার্যকর থাকছে না। বিএনপি জোটে জমিয়তে উলামার উপস্থিতি এবং জামায়াত জোটে মুক্তিযোদ্ধা ও মূলধারার রাজনীতিবিদদের সম্ভাব্য অন্তর্ভুক্তি এই বিভাজনকে অনেকটাই নিষ্প্রভ করে দিয়েছে। ফলে ভোটারদের সামনে মূল প্রশ্ন হয়ে দাঁড়াচ্ছে—কারা সংগঠিত, কারা ঐক্যবদ্ধ এবং কারা ভোটের মাঠে কার্যকর কৌশল নিয়ে হাজির হচ্ছে।
এই প্রেক্ষাপটে বিএনপির সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হয়ে উঠেছে দলীয় শৃঙ্খলা ও ঐক্য। প্রায় প্রতিটি আসনে একাধিক বিদ্রোহী প্রার্থীর উপস্থিতি বিএনপির ভোটব্যাংককে ছিন্নভিন্ন করার আশঙ্কা তৈরি করছে। উদ্বেগের বিষয় হলো, এই বিদ্রোহীদের মধ্যে শুধু তৃণমূল নয়—কেন্দ্রীয় নেতা এবং চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা পর্যায়ের নেতারাও রয়েছেন বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা যাচ্ছে। দলীয় ভোট এক বাক্সে রাখতে না পারলে বিএনপির জন্য যে কোনো সংগঠিত জোটের বিপক্ষে টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়বে।
অন্যদিকে জামায়াত–এনসিপি জোটের শক্তি নিহিত রয়েছে তাদের সমন্বিত ভোট ব্যবস্থাপনায়। ইসলামী আন্দোলন, এবি পার্টি ও অন্যান্য সমমনা দলগুলোর ভোট যদি সত্যিকার অর্থে একত্রিত হয়, তবে বহু আসনেই তারা ‘ডার্ক হর্স’ হয়ে উঠতে পারে। বিশেষ করে শহর ও আধা-শহর এলাকায় এই ভোট সমীকরণ বিএনপির জন্য অস্বস্তিকর হয়ে উঠতে পারে।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো মুক্তিযুদ্ধ প্রশ্ন। দীর্ঘদিন ধরে জামায়াত এই ইস্যুতে রাজনৈতিক চাপে ছিল। কিন্তু যদি এই জোটে কর্ণেল অলি আহমেদসহ প্রভাবশালী মুক্তিযোদ্ধারা সক্রিয় ভূমিকা নেন, তাহলে মুক্তিযুদ্ধ ইস্যুতে জামায়াত-নেতৃত্বাধীন জোটের বিরুদ্ধে বিএনপির প্রচারণা অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়তে পারে।
ডাকসু নির্বাচনে সাদিক কায়েম প্যানেলের মতো ভিন্নধর্মী জোট গঠনের উদাহরণ সামনে রেখে জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান যে কৌশলে এগোচ্ছেন, তা রাজনীতিতে নতুন ধরনের ‘ইনক্লুসিভ এলায়েন্স’-এর ইঙ্গিত দেয়। মতাদর্শগত ভিন্নতা সত্ত্বেও নির্বাচনী লক্ষ্যকে সামনে রেখে সবাইকে এক প্ল্যাটফর্মে আনার এই প্রচেষ্টা বিএনপির রাজনৈতিক শিবিরে ইতোমধ্যেই চাপ সৃষ্টি করেছে।
সব মিলিয়ে বলা যায়, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন শুধু ক্ষমতার লড়াই নয়; এটি হবে সংগঠন, ঐক্য এবং কৌশলের পরীক্ষা। বিএনপি যদি অভ্যন্তরীণ বিভক্তি কাটিয়ে উঠতে না পারে, তাহলে জামায়াত–এনসিপি নেতৃত্বাধীন নতুন জোট এই নির্বাচনে অপ্রত্যাশিত প্রভাব ফেলতে পারে—যার ফলাফল দেশের রাজনৈতিক মানচিত্রে দীর্ঘমেয়াদি পরিবর্তনও ডেকে আনতে পারে।