নিজস্ব প্রতিনিধি :
পাবনা ঈশ্বরদীর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পে কর্মরত রাশিয়ানদের পদচারণায় বদলে গেছে ঈশ্বরদী উপজেলার প্রত্যন্ত রূপপুর গ্রাম। ‘বন্ধু’ হয়েছে কমন ভাষা। বাঙালি ও রাশিয়ানরা এখন একে অপরকে ‘বন্ধু’ বলেই সম্বোধন করছে। রূপপুরকে অনেকেই এখন বলছে রুশপুর।
মাত্র সাত বছর আগেও সন্ধ্যা হলেই যেখানে কালো গভীর রাতের নিকশতা-নীরবতা নেমে আসত, সেই এলাকা এখন দিনে-রাতে সমানতালে কর্মচঞ্চলতায় মুখরিত। প্রায় সাড়ে ৫ হাজার রাশিয়ান-বেলারুশিয়ানসহ বিদেশী নাগরিকের পদচারণায় বদলে গেছে এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক চিত্র। পদ্মা নদীর তীরের ঝোপ-জঙ্গলে পূর্ণ জনশূন্য জমিতে বিদেশের আদলে গড়ে উঠেছে দৃষ্টিনন্দন আবাসিক ভবন, ঝলমলে শপিংমল, রেস্টুরেন্ট, রিসোর্টসহ অসংখ্য দোকানপাট।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প এই অঞ্চলের মানুষের ভাগ্যে বয়ে এনেছে অভূতপূর্ব উন্নয়ন। রূপপুরের মানুষ কখনো ভাবেনি যে, বিদেশী কোনো ভাষা শিখে বিদেশীদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে হবে। স্থানীয়রা যোগাযোগ, ভ্রমণ, বাণিজ্য বা সুসম্পর্ক বজায় রাখার জন্য রাশিয়ান ভাষা শিখেছে। রাশিয়ান সংস্কৃতির একটি নতুন ক্ষেত্র আবির্ভূত হয়েছে পুরো এলাকায়। রাশিয়ানদের আকৃষ্ট করতে বাজারের দোকানের সাইনবোর্ড ইংরেজির পাশাপাশি রাশিয়ান ভাষায় লেখা রয়েছে। স্থানীয় রিকশাচালকেরাও চলনসই কিছু কিছু রুশ ভাষা শিখেছেন। যেন বাংলার বুকে জন্ম নিয়েছে একখণ্ড রাশিয়া।
শুধু রূপপুর নয়, পার্শ্ববর্তী পাকশী, সাহাপুর ও ঈশ্বরদীতেও এসেছে পরিবর্তনের ছোঁয়া। বদলে গেছে এই অঞ্চলের জীবনযাত্রা। বিদেশী সংস্কৃতির ছোঁয়া লেগেছে স্থানীয়দের জীবনে। ফল ও সবজি বিক্রেতা থেকে শুরু করে বেশির ভাগ ব্যবসায়ী ও কর্মচারী শিখেছেন রাশিয়ান ভাষা। পাশাপাশি মোবাইল ফোনের ভাষা কনভার্টার অ্যাপসের মাধ্যমেও চলছে কথাবার্তা ও ভাববিনিময়।
এই বিদ্যুৎকেন্দ্রকে ঘিরে পরিবর্তন এসেছে স্থানীয়দের জীবন মানেও। এমনই একজন রূপপুর মোড়ে ছোট চা-পানের দোকানী আব্দুল আজিজ (৪৫)। সংসার স্ত্রী, দুই ছেলে এক মেয়েকে নিয়ে তার সংসার। দশ বছর আগে পাকশী ফেরিঘাটে দোকান নিয়ে বসতেন প্রতিদিন আয় ছিল ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা। আর এখন তার প্রতিদিনের আয় ৮০০ থেকে ৯০০ টাকা। তিনি জানান, রূপপুর প্রকল্প বদলে দিয়েছে তাঁর উপার্জনের চিত্র।
আব্দুল আজিজ এ রিপোর্টারকে বলেন, আয় যেমন বেড়েছে তেমনি বেড়েছে সংসারের খরচ। তাই বেশি আয় করলে বর্তমান নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধিতে সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হয়। তবে এই এলাকায় অন্য এলাকার থেকে ব্যবসা ভালো।
আব্দুল আজিজের মতো রূপপুর ও আশপাশের এলাকার অনেকেরই ভাগ্য বদলে দিয়েছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প। রূপপুর প্রকল্প ঘিরে বদলে গেছে এলাকার বিভিন্ন পেশার মানুষের আর্থ সামাজিক চিত্র। বিদেশীদের বাসস্থান "গ্রিন সিটি" ঘিরে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। যেখানকার নামই হয়ে গেছে রুশ পল্লী হিসেবে। বিদেশীদের আনাগোনায় কর্মচঞ্চল রূপপুর, জয়নগর।
গ্রিন সিটি এলাকায় সবজি বিক্রেতা সাইদুল ইসলাম বলেন, আগে এখানে দিনে সবজি বিক্রি করে সংসারে টানাটানি ছিল। রুশ পল্লী হওয়ার পর বিদেশীদের সঙ্গে বেচাকেনা করে বেশ লাভ হচ্ছে। দিন গেলে এক থেকে দেড় হাজার টাকা আয় হচ্ছে। আগের চেয়ে অনেক ভালো আছি।
স্থানীয় ওয়াও ফ্যাশনের ব্যবস্থাপক তামিম হোসেন বলেন, রুশ পল্লীতে অনেক রকম ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। বিদেশীদের আনাগোনায় খুব ভালো ব্যবসা হচ্ছে। আর্থিকভাবে অনেক মানুষ লাভবান হচ্ছে। আর এসবই সম্ভব হয়েছে রূপপুর প্রকল্পের কারণে।
স্থানীয় বাসিন্দা, অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ বলেন, রূপপুর প্রকল্পের কারণে অভূতপূর্ব আর্থসামাজিক উন্নয়ন ঘটেছে। ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটেছে। কৃষিপণ্যের ন্যায্য দাম পাচ্ছেন কৃষকেরা। প্রকল্পে কাজ করছে হাজার হাজার শ্রমিক। রূপপুরের নাম এখন বিশ্ব দরবারে পরিচিত নাম। রূপপুর প্রকল্প ঘিরে নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখছে মানুষ।
নতুনহাট এলাকায় ধুলোবালু, জরাজীর্ণ ঘরবাড়ি ও ছোট ছোট দোকানপাট এখন আর নেই। বাণিজ্যিক ভবন, স্কুল, সুউচ্চ ভবন, আন্তর্জাতিক মানের হোটেল-রেস্তোরাঁ, আধুনিক শপিংমল, সুপারশপ, তারকা হোটেল, সুইমিং পুল, রিসোর্ট বিভিন্ন নান্দনিক কর্মকাণ্ডে ভরপুর। উন্নতমানের হাসপাতালও নির্মাণ করা হয়েছে। ভাগ্য বদলের পাশাপাশি বদলে গেছে তাদের সামাজিক চিত্র। হোটেল, রিসোর্ট, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে।
গ্রিন সিটি-সংলগ্ন প্রকল্পের সাইট অফিসের ইনচার্জ রুহুল কুদ্দুস জানান, প্রকল্পে প্রায় ২৫ হাজার দেশি-বিদেশি প্রকৌশলী ও শ্রমিক কাজ করছেন। এর মধ্যে রাশিয়া, বেলারুশ, ইউক্রেন, ভারতসহ বিভিন্ন দেশের প্রায় সাড়ে ৫ হাজার কর্মকর্তা-কর্মী রয়েছেন।