বিশেষ প্রতিনিধি :
বগুড়ার শেরপুর উপজেলায় খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির দশ টাকা কেজির চাল কালোবাজারে বিক্রির মহোৎসব চলছে। ফলে হতদরিদ্র মানুষের জন্য সরকারিভাবে বরাদ্দ দেয়া এই চাল নিয়ে সুফল পাচ্ছেন না তারা। অভিযোগ উঠেছে ইউনিয়ন পর্যায়ে তালিকাভুক্ত হতদরিদ্র ব্যক্তিদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ডিলার ও তার লোকজন নয়ছয় হিসাব দেখিয়ে চালের পরিবর্তে নামমাত্র টাকা দিচ্ছেন। একইসঙ্গে বিতরণের মাষ্টাররোলেও তাদের টিপ ও স্বাক্ষর নিচ্ছেন। এরপর দরিদ্রদের জন্য বরাদ্দের ওইসব চাল চলে যাচ্ছে স্থানীয় একটি সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীর গোডাউনে। সেখানে দশ টাকা কেজির চাল বিক্রি করছেন ছত্রিশ টাকা কেজি দরে। এভাবে সুবিধাভোগীদের সঙ্গে ছলচাতুরীর মাধ্যমে তাদের চাল বিক্রি করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন ওই ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট। এছাড়া চাল বিতরণেও অনিয়ম দেখা গেছে। তালিকায় নাম থাকা অনেকেই এলাকায় নেই। আবার কেউ কেউ মারা গেছেন। তাছাড়া বেশকিছু ভুয়া কার্ডও রয়েছে। এরপরও তাদের নামে চাল বিতরণ বন্ধ নেই। নিজেরাই টিপ স্বাক্ষর করে চাল উত্তোলন দেখিয়ে তা কালোবাজারে বিক্রি করছেন তারা। তবে সব মহলকে ম্যানেজ করেই এই কাজটি করছেন বলে দাবি তাদের। তাই বিষয়টি জানার পরও ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাচ্ছে ওই ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের সদস্যরা। কারণ চাল বিতরণের প্রত্যেক মাসেই বাড়তি খরচ গুণতে হয় ডিলারদের। তাদের অভিযোগ চালের ডিও নেয়া থেকে শুরু করে বিতরণের শেষ পর্যন্ত ঘাটে ঘাটে টাকা দিতে হয়। তাই একটু সুযোগ না দিলে এসব খরচের টাকা কিভাবে জোগার হবে। উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় সূত্রে জানা যায় চলতি মাসের ২১সেপ্টেম্বর এই উপজেলায় খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির আওতায় দশ টাকা কেজি দরে চাল বিক্রি কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে। সপ্তাহের তিনদিন সোম, মঙ্গল ও বুধবার এই চাল বিক্রি করা হচ্ছে। চাল বিক্রির জন্য উপজেলার ১০টি ইউনিয়নে মোট ২০জন ডিলার রয়েছে। এসব ডিলারের দোকান থেকে তালিকাভুক্ত হতদরিদ্র ১৪ হাজার ৩৭১টি পরিবার ১০ টাকা কেজি দরে সর্বোচ্চ ৩০ কেজি চাল নিতে পারবেন। আমন ধান ঘরে আসার আগ পর্যন্ত এই কর্মসূচি চালু থাকবে। কিন্তু সরকারের এই মহতি উদ্যোগে হতদরিদ্র মানুষ কোন সুফল পাচ্ছেন না। কেবল ওই ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট লাভবান হচ্ছেন।অনুসন্ধানে জানা যায় মহামারী করোনা পরিস্থিতিতেও সু-কৌশলে সেপ্টেম্বর মাসের বরাদ্দের সিংহভাগ চাল কালোবাজারে বিক্রি করা হয়েছে। আর কাগজ-কলমে ঠিক রাখতে সুবিধাভোগীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে নামমাত্র টাকা দিয়ে বিতরণের মাষ্টাররোলে তাদের স্বাক্ষর নিয়ে রাখা হয়েছে। আবার অনেকেই এলাকায় নেই। তবুও বিতরণের মাষ্টাররোলে তাদের নামও রয়েছে। নিজেরাই টিপ স্বাক্ষর করে তাদের চাল উত্তোলন দেখিয়ে তা বিক্রি করে দিয়েছেন এক ডিলার। এমনকি বৈরী আবহাওয়ার কারণে চাল বিক্রির দিনগুলোতে সুবিধাভোগীরা না আসলেও এই ডিলারের নামে বরাদ্দের শতভাগ চাল বিক্রি প্রায় সম্পন্ন হয়েছে। সরেজমিনে গিয়ে এসব অভিযোগের সত্যতাও মিলেছে। খাদ্যগুদাম থেকে বরাদ্দের সব চাল উত্তোলন করে বিক্রয়কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া দেখানো হলেও বাস্তবে সেখানে কোন মজুদ দেখা যায়নি। মাত্র ত্রিশ কেজি ওজনের ৪৭বস্তা চাল বাদে সব চাল সুবিধাভোগীদের মধ্যে বিক্রি দেখানো হয়েছে।
এসময় জানতে চাইলে শেরপুর উপজেলার বিশালপুর ইউনিয়নের খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির ডিলার মো. লিটন জানান তার বিক্রয়কেন্দ্র থেকে ৭১৯জন কার্ডধারী হতদরিদ্র ব্যক্তি চাল কিনে থাকেন। তাঁরা বৃষ্টি উপেক্ষা করেই বিক্রয়কেন্দ্রে আসেন এবং তাদের বরাদ্দের চাল কিনে নিয়ে গেছেন। এরমধ্যে প্রথমদিনেই ৩৬৮জন ও দ্বিতীয় দিনে ২২৯ ব্যক্তি চাল ক্রয় করেন। আর সামান্য কয়েকজন ব্যক্তি বাকি থাকলেও তারাও আসছেন এবং চাল নিয়ে যাচ্ছেন বলে দাবি করেন তিনি। তবে তিনদিনের মধ্যে সব সুবিধাভোগীর মধ্যে ওই চাল বিতরণকে অনেকেই অস্বাভাবিক বলে মন্তব্য করেছেন।
অপরদিকে অন্যান্য ইউনিয়নে গিয়ে দেখা যায় ডিলারের বিক্রয়কেন্দ্রের চারপাশেই যেন চাল বিক্রির হাট বসেছে। সুবিধাভোগী ব্যক্তিরা চাল নিয়ে পাশেই কালোবাজারিদের কাছে নামমাত্র টাকায় বিক্রি করে দিচ্ছেন। কারণ জানতে চাইলে সুবিধাভোগী সুফিয়া বেগম, মজিবর সেখ, কালু মিয়া, আঞ্জুয়ারা বেগম, বাবু মিয়াসহ একাধিক ব্যক্তি জানান, এসব চাল খুবই নিম্নমানের। খাবার অযোগ্য। এছাড়া হাইব্রিড মোটা ধানের চাল নিতে অনেকেই আগ্রহী নয়। এছাড়া এই চালের ভাত ঠিকভাবে খাওয়াও যায় না। তাই চাল বিক্রি করে যে টাকা পাওয়া যায় সেটি অনেক ভালো বলে জানান তারা। আর এই সুযোগ নিয়েছেন ওই ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট। তারা খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির চাল নিয়ে চালবাজি শুরু করেছেন। দরিদ্র মানুষের নিকট থেকে কমদামে চাল কিনে গোডাউনে ভরছেন। পরবর্তীতে সেসব চাল প্রায় চারগুণ বেশি দামে বিক্রি করছেন। এরই ধারাবাহিকতায় গত ২১ সেপ্টেম্বর দিনগত রাতে শহরের হাটখোলা এলাকায় এই কর্মসূচির ৩০০বস্তা চাল কালোবাজারে বিক্রিকালে হাতেনাতে আটক করা হয়। তবে ওই সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীর প্রধান এক ব্যক্তির মধ্যস্থতায় লাখ টাকার বিনিময়ে রফাদফা করে ঘটনাটি ধামাচাপা দেয়া হয়েছে বলে সূত্রটি জানায়। বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক সেকেন্দার মো. রবিউল ইসলাম বলেন মৌখিক অভিযোগের ভিত্তিতে ওই ডিলারের চাল বিক্রির বিষয়ে খোঁজখবর নেয়া হচ্ছে। সেখানে কোন অনিয়ম হয়ে থাকলে অবশ্যই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। এছাড়া সুবিধাভোগীরা চাল বিক্রি করতে পারবেন কি-না তা পরিপত্রে পরিস্কার করে কিছু বলা নেই। এরপরও খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির চাল কেনাবেচা বন্ধে কঠোর নির্দেশনা দেয়া হয়েছে বলে দাবি করেন তিনি। উপজেলা নির্বাহী নির্বাহী কর্মকর্তা মো. লিয়াকত আলী সেখ এ প্রসঙ্গে বলেন বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে খতিয়ে দেখা হবে। সেইসঙ্গে এহেন কর্মকাণ্ডে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে।