অর্থনৈতিক ডেস্ক :
সমগ্র বিশ্বব্যাপী সরবরাহ সংকটের কারণে বেশিরভাগ নিত্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধির মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। পূর্বাভাসের চেয়েও বেশি হারে বেড়েছে জ্বালানি তেল ,বিদ্যুৎ,কয়লা,গ্যাস সহ নিত্যপণ্যের দাম। বিশ্বব্যাংকের হিসাব মতে গত বছরের তুলনায় জ্বালানির দাম গড়ে প্রায় ৮০ শতাংশ বেড়েছে। চলতি বছরের শুরুর দিকে খাদ্যপণ্যের দাম গড়ে বেড়েছে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত। বর্তমানে কিছুটা কমে আসলেও পরিস্থিতি স্বাভাবিক নিয়ন্ত্রণে আসতে আরো অনেক সময় লাগবে।
বাণিজ্যিক তথ্য মতে এ বছর ব্যারেল প্রতি অপরিশোধিত জ্বলানি তেলের দর গড়ে ৭০ ডলার থাকলেও আগামী বছর গড়ে ৭৪ ডলার পর্যন্ত হতে পারে বলে পূর্বা আভাস পাওয়া যাচ্ছে, গতকাল প্রকাশিত “কমোডিটি মার্কেটস আউটলুক” প্রতিবেদনে এই পূর্বাভাস দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। প্রতি ত্রৈ-মাসিক ভিত্তিতে সংস্থাটি এ পূর্বাভাস প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এবারের প্রতিবেদনে অবশ্যই আশা করা হয়েছে আগামী বছর নিত্যপণ্যের বাজার স্থিতিশীল হয়ে আসবে।
বর্তমান বাজারে নির্ধারিত দামের চেয়ে লিটারে ৯ টাকা বেশিতে বিক্রি হচ্ছে সয়াবিন
কমোডিটি মার্কেট আউটলুক প্রতিবেদনে বিশ্বব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ আয়হান কোস উল্লেখ করেছেন, জ্বালানির এই দাম বৃদ্ধির ফলে শীঘ্রই বিশ্বে মূল্যস্ফীতির উল্লেখযোগ্য ঝুঁকি তৈরি হবে। যদি দাম বাড়তেই থাকে সেক্ষেত্রে জ্বালানি আমদানি নির্ভর দেশগুলোতে চাপ বাড়বে। মহামারী করোনার কারণে নিত্যপণ্যের দাম যে হারে কমেছিল এখন সেটি খুব দ্রুত বেড়ে যাচ্ছে। দ্রব্যমূল্য অস্থিতিশীল থাকলে দেশগুলোর নীতি নির্ধারণে চাপ বাড়বে।
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, এ বছর কিছু নিত্যপণ্যের দাম ২০১১ সালের তুলনায় বেশি লক্ষ্য করা গেছে। উদাহরণ দিয়ে বলা হয়েছে, পর্যাপ্ত সরবরাহ না থাকায় প্রাকৃতিক গ্যাস এবং কয়লার দাম রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছেছে। তাছাড়া বিদ্যুতের চাহিদা এখন করোনার আগের পর্যায়ে ফিরেছে, তাই জ্বালানির চাহিদাও বেড়েছে। আগামী বছর অর্থাৎ ২০২২ সালে চাহিদা স্বাভাবিক হলে দাম স্থিতিশীল হয়ে আসবে। তবে প্রতিবেদনে সতর্ক করে বলা হয়েছে, প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুত কমে আসা এবং সরবরাহ পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে জ্বালানির দাম আরো বেড়ে যেতে পারে।
পূর্বাভাসে আরো বলা হয়েছে, অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দর (ব্রেন্ট, ডব্লিউটিআই এবং দুবাই) এ বছর গড়ে ৭০ ডলার (প্রায় ৬ হাজার টাকা) পর্যন্ত থাকতে পারে। আগামী বছর এই দাম গড়ে ৭৪ ডলার (প্রায় ৬ হাজার ৩০০ টাকা) থাকতে পারে। উল্লেখ্য, করোনার প্রকোপ শুরুর পর বিশ্ববাজারে তেলের দাম তর তর করে নামতে থাকে। চাহিদা না থাকায় এক পর্যায়ে ঋণাত্মক পর্যন্ত হয়ে যায়। গত বছর গড়ে যে দামে বিক্রি হয় এবছর সেটি ৭০ শতাংশ পর্যন্ত ফিরে এসেছে। তবে দ্রুত দর বৃদ্ধির প্রবণতা বিশ্ব অর্থনীতির প্রবৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে বলেও সতর্ক করেছে বিশ্বব্যাংক। করোনার প্রকোপ কমতে থকায় এখন বিশ্ব অর্থনীতি ঘুড়ে দাঁড়াচ্ছে। সরবরাহ সংকট কেটে গেলে আগামী বছর বিশ্ববাজারে ধাতব পণ্যের দাম ৫ শতাংশ কমে আসতে পারে। তবে এ বছর ধাতব পণ্যের মূল্য গড়ে ৪৮ পর্যন্ত বেড়েছে। অবশ্যই আগের পূর্বাভাস প্রতিবেদনে ধারণা করা হয়েছিল গড়ে ২২ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তে পারে ধাতব পণ্যের দাম। গত বছর ব্যাপক হারে কমে যাওয়ার পর ধারণা করা হয়েছিল এ বছর চাহিদা বাড়বে। কিন্তু ধারণার চেয়েও বেশি হারে চাহিদা বেড়েছে।
বিশ্বব্যাংকের জেষ্ঠ্য অর্থনীতিবিদ জন বাফেস উল্লেখ করেছেন, জ্বালানির উচ্চমূল্য মূল্যস্ফীতির চাপ বাড়ায়। তাছাড়া জ্বালানির দাম বাড়লে সার উৎপাদনের খরচও বেড়ে যায়। ফলে ফসল উৎপাদনে খরচও বাড়ে। উত্পাদন খরচ বৃদ্ধি পাওয়ায় ইতিমধ্যে এলুমিনিয়াম এবং জিংকের উৎপাদন কমে গেছে।
প্রতিবেদনে কৃষিপণ্যের বাজার বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, এ বছরের শুরুর দিকে বিশ্ববাজারে আগের বছরের তুলনায় দাম বেড়েছে প্রায় ৩০ ভাগ। করোনার প্রকোপে গত বছর একেবারেই কমে গিয়েছিল নিত্য পণ্যের দাম। গত দুই প্রান্তিকে মোটামুটি স্থিতিশীল রয়েছে কৃষি পণ্যের বাজার। এখন স্থিতিশীল থাকলেও কৃষি পণ্যের দাম গত বছরের চেয়ে গড়ে ২৫ শতাংশ বেশি রয়েছে। করোনার আগের অবস্থায় ফিরে আসছে কৃষি পণ্যের বাজার। আট বছরের মধ্যে এখন খাদ্য মূল্য সূচক সবচেয়ে বেশি। ভুট্টার দাম অতি সম্প্রতি কিছুটা কম হলেও গত বছরের তুলনায় ২৫ শতাংশ দাম বেড়েছে। গত মে মাসে প্রতি মেট্রিক টন ভুট্টা ৩০০ ডলার পর্যন্ত চড়েছিল।
মূলত উৎপাদন কম হওয়া, পশু খাদ্যের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় ভুট্টার দর বেড়েছিল। এখন সেপ্টেম্বরে ২৩০ ডলারের নেমে এসেছে ভুট্টার দর। সরবরাহ সংকটে চালের দাম এ বছরের শুরুর দিকে ৭ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ হয়ে গিয়েছিল। গত ত্রৈ-মাসিক হিসাবে এটি ১৮ শতাংশ কমে এসেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে গড়ে প্রতি মেট্রিক টন চাল এখন ৪০৬ ডলারে নেমেছে। ভোজ্য তেলের দাম কিছুটা কমে আসলেও এখনো গত বছরের চেয়ে ৪০ শতাংশ বেশি দরে বিক্রি হচ্ছে। এপ্রিল-জুন প্রান্তিকে পাম ও সয়াবিন তেলের দাম গত ১০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে উঠেছিল। মূলত দক্ষিণ আমেরিকার সয়াবিন ও পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে পাম উত্পাদন কমে যাওয়ায় এই সংকট তৈরি হয়েছিল। তাছাড়া চীন সয়াবিনের আমদানি বাড়িয়েছে ব্যাপক হারে। পর্যাপ্ত সরবরাহ না থাকায় ভোজ্য তেলের দাম বেড়েছে লাফিয়ে লাফিয়ে।
বিশ্বব্যাংকের বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, জীবাশ্ম জ্বালানির সরবরাহ সংকটের ফলে এখন জলবিদ্যুত্, সোলারের মতো নবায়নযোগ্য জ্বালানির চাহিদা বেড়ে যাবে। নীতি নির্ধারকদের এ বিষয়ে ভাবতে হবে। বিশ্বব্যাংকের এবারের বিশ্লেষণে নগরায়ণের সঙ্গে নিত্যপণ্যের চাহিদার বিশ্লেষণ করা হয়েছে। নগরায়ণ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুতের চাহিদাও বেড়েছে। ফলে কার্বন নিঃসারণ বৃদ্ধির ঝুঁকি বাড়ছে। পরিকল্পিত নগরায়ণের মাধ্যমে এই ঝুঁকি হ্রাস করা সম্ভব। গত ৫০ বছরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নগরে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা ৩৭ শতাংশ থেকে বেড়ে ৫৬ শতাংশ হয়েছে। অর্থাত্ এই অর্ধ শতাব্দীতে নগরে মানুষ বেড়েছে ৩০০ কোটি। শুধু চীনে নগরবাসীর সংখ্যা ৭০ কোটি বেড়েছে। ধারণা করা হচ্ছে ২০৫০ সাল নাগাদ বিশ্বের ৬৯ শতাংশ মানুষ শহরে বাস করবে। সেই অনুপাতে বিদ্যুতের চাহিদাও বাড়বে।