অনলাইন ডেস্ক রিপোর্ট :
কলসি হাতে নারীদের জটলা, খুব ভোরে গ্রামের নারীদের কাছে এটি নতুন দৃশ্য নয়। প্রতিদিন ভোরেই কলসি হাতে টিউবওয়েলের পানি আনতে দেখা যায় নারীদের। কিন্তু মসজিদ ধোয়ার পানি খেয়ে ভালো কিছু পাওয়ার নিয়তে নারীদের জটলা কৌতূহলের বিষয়। তাও আবার ২০ বছর ধরে মাইলের পর মাইল দূর থেকে এসে মসজিদ ধুয়ে দিচ্ছেন নারীরা। এখন পুরুষরাও যুক্ত হয়েছেন। তবে এটিকে ধর্মীয় কুসংস্কার ও বিদয়াত হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন আলেম-ওলামারা।
জানা গেছে, প্রতি শুক্রবার ভোরে লক্ষ্মীপুরের কমলনগর উপজেলার চর মার্টিন ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের ছেরাজ আমিন জামে মসজিদ ধুয়ে দিতে ভিড় জমান নারীরা। আধাপাকা মসজিদটি ধোয়ার জন্য এখন পুরুষদেরও দেখা মিলে। রোগমুক্তি, পরীক্ষায় ভালো ফলাফল ও চাকরিসহ বিভিন্ন নিয়ত পূরণ হওয়ার আশায় মসজিদ ধুয়ে দিতে ভিড় জমান তারা। অনেকে মনের আশা পূরণের জন্য বোতলে করে পানি নিয়ে যান বাড়িতে।
সরেজমিনে দেখা যায়, ফজরের নামাজ শুরুর আগেই বিভিন্ন বয়সী কয়েকজন নারী এসে মসজিদ ঘরের পাশে পুকুর ঘাটে দাঁড়িয়ে আছেন। কথাবার্তায় বুঝা গেল বহুদূর থেকে ছুটে এসেছেন তারা। ফজরের নামাজ শেষ হওয়ার পরপরই মুসল্লিরা মসজিদ থেকে বের হয়ে দ্রুত মসজিদ খালি করে দেন। পরের দৃশ্যটা আরও অন্যরকম। দাঁড়িয়ে থাকা নারীরাসহ আরও অনেকেই জগ ও ছোট কলসি হাতে নিয়ে নেমে পড়েন মসজিদ ধোয়ার কাজে। পাশের পুকুর ও নলকূপ থেকে হিসেব করে তিন জগ কিংবা তিন কলসি পানি নিয়ে এসে ঢেলে দেন মসজিদের দরজা, বারান্দা এবং মেহরাবে।
অনেকেই মসজিদ ধুয়ে গড়িয়ে পড়া কিছু পানি বোতলে নিয়ে বাড়ির উদ্দেশে রওয়ানা দেন। কেউ কেউ দুই রাকাত নামাজও আদায় করেন। অনেককে মসজিদের দরজা, দেয়াল এবং মেহরাব ধরে কাঁদতেও দেখা গেছে। নারীদের পাশাপাশি কয়েকজন যুবককেও দেখা গেছে একই কাজে।
স্থানীয় সূত্র জানায়, বহু বছর (আনুমানিক ১৯৫০ সাল) আগে মেঘনা নদী ভাঙতে ভাঙতে বর্তমান লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার ভবানীগঞ্জ এলাকায় পৌঁছায়। তখন ভবানীগঞ্জ এলাকার করিম বক্স জামে মসজিদটি নদী ভাঙনের কবলে পড়ে। পরবর্তীতে কমলনগর উপজেলার চর মার্টিন ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডে নতুনভাবে স্থাপন করা হয়। মসজিদের নতুন স্থানটি জনৈক ছেরাজ আমিনের দখলে ছিল। তাই এর নামকরণ করা হয় ছেরাজ আমিন মসজিদ। মসজিদটি প্রথমে খড়ের ছাউনির থাকলেও পরে টিনের ছাউনি দেয়া হয়। অন্যান্য মসজিদের ন্যায় সাধারণ মসজিদ ছিল এটি।
কমলনগরের হাজিরহাট থেকে ছুটে আসা মধ্যবয়সী নারী জেবুন্নেছা জানান, তিনি মসজিদ ধোয়া কিছু পানি বোতলে ভরে নিয়েছেন। রোগ মুক্তির লক্ষ্যে বাড়িতে গিয়ে সেগুলো পান করবেন।
আবদুর রহমান নামে এক শিক্ষার্থী জানায়, তার এসএসসি পরীক্ষা চলছে। মা-বাবার কথা মতো সে পরীক্ষার ভালো করার নিয়তে মসজিদ ধুয়েছে।
মসজিদ এলাকার বাসিন্দা সালেহা বেগম জানান, তরুণী থেকে বৃদ্ধা সকল বয়সের নারী বিভিন্ন নিয়তে এখানে আসছে। তবে এখন নারীদের পাশাপাশি পুরুষদেরও আসা শুরু হয়েছে। বর্তমানে প্রতি শুক্রবার পূর্বের তুলনায় লোকসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। অনেকে মসজিদ ধোয়া পানি বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছেন খাওয়ার নিয়তে। অনেক নিয়ত করে নামাজও পড়ছেন। কেউ কেউ মসজিদের দেয়াল ছুয়ে কান্নাকাটি করছেন। যারা একবার পানি দিয়ে মসজিদ ধুয়েছে তাদেরকে আসতে হবে পরপর তিন শুক্রবার।
গ্রামের শাহে আলম পূর্বের মুরব্বিদের বরাত দিয়ে জানান, তিনি শুনেছেন প্রায় ২০ বছর আগে বর্তমান ইমামের বাবা নাকি স্বপ্ন দেখেন- যেসব নারী শুক্রবার এ মসজিদ ধুয়ে দেবেন বিনিময়ে তার মনের আশা পূরণসহ রোগমুক্তি হবে। এ কথাটি কোনো এক নারীর কান হয়ে এখন হাজার হাজার নারীর কানে পৌঁছে গেছে। এখন প্রতি শুক্রবারই শতশত নারী ছুটে আসছেন মনের আশা পূরণের জন্য।
মসজিদের ইমাম মাওলানা জাহের বলেন, ঘটনাটি সত্য। কিন্তু কীভাবে এটা শুরু হয়েছে তা জানি না। নারীদেরকে এ কাজ থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করেছি। এটাকে বিদয়াত হিসেবেও সবার কাছে তুলে ধরা হয়েছে। কিন্তু কেউ কথা শুনছে না।
মসজিদ পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও চর মার্টিন ইউনিয়নের মেম্বার (ইউপি সদস্য) মো. শাহাব উদ্দিন জানান, বিভিন্ন নিয়ত বা মানত করে রোগমুক্তির আশায় অন্তত ২০ বছর ধরে নারীরা এ কাজ করে যাচ্ছে। এ ধরনের কাজ থেকে বিরত থাকার জন্য তিনি নারীদেরকে বিভিন্ন সময় নিষেধ করেছেন। কিন্তু কেউ শুনছে না।
জানতে চাইলে কমলনগরের হাজিরহাট হামেদিয়া ফাজিল মাদরাসার অধ্যক্ষ যায়েদ হোসেন ফারুকী বলেন, মক্কা, মদিনা এবং বায়তুল মোকাদ্দাসের মতো তিনটি মসজিদ বাদে আল্লাহর কাছে পৃথিবীর সকল মসজিদের গুরুত্বই সমান। সুতরাং কোনো একটি বিশেষ মসজিদকে নিয়ত করে ধুয়ে দেয়া বিদয়াত হবে। তিনি মুসলমানদের এ রকম কাজ থেকে বিরত থাকার অনুরোধ করেন।
এদিকে নিয়ত করে মসজিদ ধোয়াকে ধর্মীয় কুসংস্কার ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কাজ আখ্যা দিয়ে তা বন্ধ করতে প্রশাসনের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন স্থানীয় মুসল্লিরা।