অনুসন্ধান কালে নিউজ না করতে সাংবাদিক দিয়ে তদবির দ্রুত ব্যবস্হা নিতে পরিবেশ দপ্তরের দৃষ্টি আকর্ষণ।
এম শাহীন আলম :
কুমিল্লার সদর দক্ষিণ উপজেলার সুয়াগাজী বাজারে দক্ষিনে ধনপুর নামক স্হানে “কিষোয়ান স্ন্যাক্স লিমিটেড ও বনফুল অ্যান্ড কোং” নামে দু’টি কারখানার বিষাক্ত বর্জ্যের দূরগন্ধের কারখানাটির আশপাশ এলাকার প্রায় ২০টি গ্রামের মানুষের জীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। কারখানাটির পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া সরকারি খালটি বিষাক্ত বর্জের কারনে মরা খালে পরিণত হয়েছে। কারখানার বিষাক্ত বর্জে আশাপাশ এলাকার কৃষি জমির ব্যাপক ক্ষতির অভিযোগও রয়েছে।
সরেজমিনে অনুসন্ধানে দেখা যায়, ঢাকা চট্রগ্রাম মহাসড়কের পাশে কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলার সুয়াগাজীর দক্ষিনে ধনপুর এলাকায় কিষোয়ান গ্রুপের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান কিষোয়ান স্ন্যাক্স লিমিটেড নামে শিল্প কারখানাটি ২০১৫ সাল থেকে বিভিন্ন স্ন্যাক্স বেকারি আইটেম উৎপাদন চালিয়ে আসছে। পাশে রয়েছে “বনফুল অ্যান্ড কোং” নামে রয়েছে আরেকটি কারখানা। এ শিল্প কারখানাগুলো তরল বর্জ্য পরিশোধনাগার (ইটিপি) যথাযথ ব্যবহার না থাকায় এই দুই কারখানায় পাইপ থেকে নির্গত হচ্ছে বিষাক্ত তরল পদার্থ, যা সরাসরি গিয়ে পড়ছে পার্শ্ববর্তী খালে। যার কারণে সদর দক্ষিণ ও চৌদ্দগ্রাম উপজেলার প্রায় ২০টি গ্রামের সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা বিপর্যস্ত সহ কৃষি জমির হচ্ছে ব্যাপক ক্ষতি। এই কারখানা গুলোর বর্জের কারনে খালের আশপাশ এলাকার কয়েক’শ একর কৃষি জমি অনাবাদি হয়ে পড়ে আছে।
সরেজমিনে আরো দেখা যায়,ওই কারখানা থেকে নির্গত বর্জ্য খোলা স্থানে ও পার্শ্ববর্তী খালটিতে বর্জ্য ফেলার কারনে পরিবেশের ক্ষতিসহ এলাকার কয়েক শ’ হেক্টর আবাদী জমির ধানসহ বিভিন্ন ফসল নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি, কারখানাটির চুল্লি থেকে নির্গত ধোঁয়ার প্রভাবে বিষাক্ত হয়ে পড়েছে এই এলাকার পরিবেশ। এছাড়া সরকারি খালটি দখল নিয়ে সেখানে বর্জ্য ফেলছে এই দুই কোম্পানি। বিগত দিনে স্হানীয় এলাকাবাসী এই বিষয়ে জেলা প্রশাসক ও পরিবেশ অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন দপ্তরে লিখিত অভিযোগ দিয়েও সুফল পায়নি। বিষাক্ত বর্জ্যের পলিথিন ও ময়লা আবর্জনা ফেলায় সরকারি খালটি বর্তমানে ময়লা বর্জ্যের বাগারে পরিণত হয়েছে।
এই বিষয়ে স্থানীয় কৃষকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, কারখানার দূষিত বর্জ্য খালে-বিলে ফেলার কারণে এ উপজেলার ২০ গ্রামের মানুষ পুকুর ও নদীর পানি কোনও গৃহস্থালি কাজে ব্যবহার করতে পারছে না। এই পানি ব্যবহারের কারণে চর্ম রোগসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে শত শত মানুষ। এছাড়া দুইটি কারখানার পিছনের অংশে আমাদের জমিগুলোতে বর্জ্য ফেলে সাবেক ইউপি সদস্য মো. সোহেলের মাধ্যমে কৃষকদের চাপ প্রয়োগ করে জমিগুলো ক্রয় করতে চায়। জমি বিক্রি করতে অস্বীকৃতি জানালে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের মাধ্যমে মামলা দেওয়ার হুমকি দেয়।
এই বিষয়ে অভিযুক্ত সাবেক ইউপি সদস্য সোহেল মিয়ার কাছে জানতে চাইলে বলেন, আমার বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ মিথ্যা। আমি আর কিছু বলতে পারবো না।
সদর দক্ষিন উপজেলার পূর্ব জোড় কানন ইউনিয়নের কৃষক বারেক মিয়া ও জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, এই কলকারখানাগুলোর বিষাক্ত পানি মাটি ও পানিতে মেশায় জমিতে কিছু ফলানো যাচ্ছে না। যে বীজই দিই, কোনো লাভ হয় না। এগুলো দেখার কেউ নাই। কয়েকদিন পর পর আমাদেরকে জমি বিক্রি করতে বলে, অনেকে ভয়ে বিক্রি করছে, আমরা করিনি।
ধনপরের আরেক কৃষক মোবারক হোসেন বলেন, এই বিষাক্ত পানির কারণে পুরো এলাকার জমিগুলোয় ফলন হয় না। আর এগুলোতে ফলন না হওয়ায়, কোম্পানির লোকেরাই জমিগুলো কিনে নেয়। এভাবে এই পুরো এলাকা অনাবাদী হয়ে পড়ছে। আমরা যারা কৃষি কাজ করি তাদের কি হবে বলেন। আমরা কি করে খাবো বলেন।
কিষোয়ান স্ন্যাক্স লিমিটেড এর ব্যবস্থাপক (প্রশাসন) এবিএম বোরহান উদ্দিন বলেন, আমরা ইটিপি’র মাধ্যমে বর্জ্য পরিশোধিত করছি। বৃষ্টি নাই, তাই খালে কিছু ময়লা জমা হচ্ছে। আমরা মূলত ড্রাই আইটেম তৈরি করি, এগুলোতে আমরা কোনো ক্ষতিকর কেমিক্যাল মিশাই না। আর, আমরা বাহিরেও কোনো বর্জ্য ফেলছি না। আমরা আইন মেনেই সব পরিচালনা করছি। বোরহানউদ্দিন বলেন, এগুলো আমাদের কারখানার বর্জ্য নয়, খালের বর্জ্য গুলো বনফুলের বলে তিনি দাবী করেন।
বনফুল অ্যান্ড কোং’র এজিএম শেখ ফরিদ বলেন, বর্ষা মৌসুমে খালে পানির চলাচল থাকায় ময়লাগুলো চলে যায়। কিন্তু, এই শুষ্ক মৌসুমেস খালে পানি চলাচল না থাকায় কিছু সমস্যা হচ্ছে আর আমরা ইটিপি ব্যবহার করছি। এই খাল তো এমনিতেই মরা খাল। ইটিপি পরিশোধন ছাড়া কোনো পানি বাহিরে যায় না। তাছাড়া,খাল ময়লা হলেও আমরা নিজেরাই কিছুদিন পর পর খাল পরিষ্কার করে দিই।
গত ফেব্রুয়ারী মাসের প্রথম দিকে সরেজমিন অনুসন্ধানকালে কিষোয়াণ স্ন্যাক্স লিমিটেডের ব্যবস্হাপক এবিএম বোরহান উদ্দিন তাৎক্ষনিক তার কারখানার অফিসে বসা অবস্হায় তিনি তার মোবাইল ফোনে তার পরিচিত দুই সাংবাদিক দিয়ে নিউজ না করতে তদবির চালায়। তৎসময়ে সাংবাদিকদের সন্মান রক্ষার্থে খালের বর্জ্য নিরসন সহ ভবিষ্যতে পরিবেশ যেন নস্ট না হয় সেই ওয়াদাতে ১৫ দিনের সময় দেওয়া হয়। কিন্তুু ১৫ দিনের বেশি সময় অতিবাহিত হলেও তাদের বর্জ্য ব্যবস্হাপনা কার্যক্রমের উন্নতি না ঘটায় ধারাবাহিক নিউজ চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো।
কুমিল্লা পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মোসাব্বের হোসেন মোহাম্মদ রাজীব বলেন, আমরা বিষয়টি জেনেছি। সেখানে পরিবেশ অধিদপ্তরের লোক পাঠানো হবে। এ ঘটনা সত্য হলে অবশ্যই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সদর দক্ষিণ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রুবাইয়া খানম বলেন, বিষয়টি সম্পর্কে আমি অবগত ছিলাম না। আমি সরেজমিনে গিয়ে বিষয়টি তদন্ত করে এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।
কুমিল্লার পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী খান মোহাম্মদ ওয়ালিউজ্জামান বলেন, সরকারি খালগুলো উদ্ধারের আমরা চেষ্টা চালাচ্ছি। ইনশাআল্লাহ আমরা সরেজমিনে বিস্তারিত জেনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিবো।