ছিনতাই করা চলন্ত বাসে যাত্রীদের ৩ ঘণ্টা জিম্মি করে ডাকাতি ও ধর্ষণ

অপরাধ

বিশেষ প্রতিবেদক :
কুষ্টিয়া থেকে যাত্রী নিয়ে চট্টগ্রাম যাচ্ছিল ঈগল পরিবহণ নামে একটি বাস। বঙ্গবন্ধু সেতুর পশ্চিমপাড়ে পৌঁছালে এতে ১০-১২ জন যাত্রী ওঠেন। যাত্রীবেশে ওঠা এই যাত্রীরা বাসটির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বাকি যাত্রীদের জিম্মি করে ফেলে। হাত-মুখ ও চোখ বেঁধে অস্ত্রের মুখে টানা তিন ঘণ্টা জিম্মি করে রাখা হয় যাত্রীদের। এই পুরো সময় বাসটি চলন্ত অবস্থায় ছিল। এর মধ্যেই চলে ডাকাতি ও ধর্ষণ। মধুপুরের কাছে এসে বাসটি দুর্ঘটনার শিকার হলে স্থানীয়রা এসে যাত্রীদের উদ্ধার করেন।

বঙ্গবন্ধু সেতুর পশ্চিমপাড় থেকে ছিনতাই করা বাসের যাত্রীদের সর্বস্ব লুটের পর নারী যাত্রীদের পালাক্রমে ধর্ষণের এ ঘটনা ঘটেছে আজ বুধবার ভোরে। আন্তজেলা ডাকাত দলের সদস্যদের এই ভয়াবহ কাণ্ডের শিকার হয়েছেন কুষ্টিয়া-চট্টগ্রাম চলাচলকারী ঈগল পরিবহনের যাত্রীরা।

বাস যাত্রীদের কাছ থেকে জানা যায়, গতকাল মঙ্গলবার কুষ্টিয়া থেকে ঈগল পরিবহনের একটি বাস অন্তত ২৫ জন যাত্রী নিয়ে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে ছেড়ে আসে। বাসটি বঙ্গবন্ধু সেতু পার হলে যাত্রীবেশী ডাকাতেরা অস্ত্রের মুখে ঘুমন্ত যাত্রীদের হাত-মুখ ও চোখ বেঁধে জিম্মি করে। এর পর যাত্রীদের কাছে থাকা মোবাইল, টাকা, স্বর্ণালংকার লুট করে নেয়। পরে ডাকাত দলের সদস্যেরা গাড়িতে থাকা নারী যাত্রীদের ধর্ষণ করে বলে জানান একাধিক যাত্রী।
টানা তিন ঘণ্টা যাত্রীদের ওপর চালানো নির্যাতনের পর টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলার রক্তিপাড়া নামক স্থানে এসে বাসটির গতি থামিয়ে ডাকাত দল নেমে যায়। মুহূর্তের মধ্যেই চোখ-মুখ ও হাত বাঁধা যাত্রীদের নিয়ে বাসটি রাস্তার পাশের বালুর ঢিবিতে কাত হয়ে পড়ে দুর্ঘটনার শিকার হয়। স্থানীয়রা এগিয়ে এসে তাঁদের উদ্ধার করেন।
কুষ্টিয়া থেকে ছেড়ে আসা বাসটিতে নাটোরের বড়াই গ্রামের বাসিন্দা ফল ব্যবসায়ী হাবিবুর রহমান যাত্রী হন রাত ১০টায়। তিনি নাটোরের তরমুজ চত্বর থেকে বাসে ওঠেন। তিনি আমড়া, কাঁঠাল ও তাল ঢাকায় বিক্রি করার জন্য নিয়ে যাচ্ছিলেন।

ঈগল পরিবহনে অনেক দিন ধরে নিয়মিত যাতায়াত করা এই ভুক্তভোগী যাত্রী বলেন, আমরা বাসে উঠে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। আমাদের বাসটি সিরাজগঞ্জের কাছাকাছি দিবারাত্রি হোটেলে রাতের খাবারের জন্য বিরতি দেয়। বাসের অনেকেই ওই হোটেলে খাবার খান। আমিও ওই বাসের সুপারভাইজার রাব্বি ও সহযোগী দুলালের সাথে বসে খাবার খেয়েছি। আগে যে চালক বাস চালাতেন, আজ সেই চালক ছিলেন না। কড্ডার মোড়ে আসার পর গেঞ্জি, শার্ট পরা ১০-১২ জন যাত্রী ওঠেন। তাঁদের প্রত্যেকেরই পিঠে ব্যাগ ছিল। তাঁরা বাসের খালি সিটগুলোতে বসে পড়েন। বাসটি বঙ্গবন্ধু সেতু পার হওয়ার পর যাত্রীবেশে ওঠা এই ডাকাত দলের সদস্যেরা অন্য ঘুমন্ত যাত্রীদের অস্ত্রের মুখে একে একে বেঁধে ফেলে। একই সঙ্গে প্রত্যেক যাত্রীর চোখ ও মুখ বেঁধে জিম্মি করে বাসের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় তারা। এমনকি শিশুদেরও একই কায়দায় বেঁধে রাখে তারা। পরে সব যাত্রীর কাছ থেকে মোবাইল, টাকা, গয়না লুট করে নেয়। তার পর নারী যাত্রীদের ওপর পাশবিক নির্যাতন চালায়।

হাবিবুর রহমান বলেন, আমার পাশে বসা নারীকে চার দফায় ধর্ষণ করা হয়েছে বলে আমি অনুধাবন করতে পেরেছি। আমরা অসহায় ছিলাম। হাত, মুখ, চোখ বাঁধা ছিল। কিছুই করতে পারিনি। টানা তিন ঘণ্টা আমরা ওই বাসটিতে জিম্মি ছিলাম। বাসটি কোথা থেকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে, আমরা কিছুই জানি না। দুর্ঘটনায় শিকার হওয়ার পর আমরা জানতে পারি, টাঙ্গাইলের মধুপুরের রক্তিপাড়া এলাকায় আছি।

এদিকে খবর পেয়ে কুষ্টিয়া থেকে মধুপুরে আসেন ঈগল পরিবহনের ব্যবস্থাপক আয়নাল হোসেন। গাড়িটির চালক ও সহযোগীদের বরাত দিয়ে তিনি বলেন, মির্জাপুরের পাকুল্লা এলাকার একটি ফাঁকা মাঠে বাসটি ঘুরিয়ে টাঙ্গাইলের দিকে নিয়ে নেওয়া হয়। পরবর্তীতে বাসটিকে ময়মনসিংহের মহাসড়কের মধুপুরের দিকে নেয় ডাকাতেরা।

বাসের নারী যাত্রী কুষ্টিয়ার দৌলতপুর থানার তারাগুনিয়া গ্রামের শিল্পী বেগম বলেন, আমি আমার অসুস্থ মেয়েকে চিকিৎসার জন্য ঢাকায় নিয়ে যাচ্ছিলাম। আমাদের সবাইরে হাত, মুখ, চোখ বাইন্দা ডাকাতরা সব লুট কইরা নিছে। আমার স্বামী পিয়ার আলিকে ছুরি দিয়ে আঘাত করছে। আমার কাছ থিকা ৩০ হাজার টাকা নিয়া গেছে। ওই বাসে থাকা অন্য নারী যাত্রীরা নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বলে জানান তিনি।

বাসটিতে করে বেসরকারি চাকরিজীবী নারায়ণগঞ্জের বাসিন্দা আব্দুর রশিদ নাটোর থেকে বাড়ি যাচ্ছিলেন অসুস্থ মাকে দেখার জন্য। সঙ্গে ছিল বেতনের ২২ হাজার ৮০০ টাকা। এর মধ্যে ১০০ টাকা রেখে বাকি পুরো টাকাই ডাকাতেরা নিয়ে গেছে বলে জানান তিনি।
বাসযাত্রী হাবিবুর রহমান বলেন, স্থানীয় বাসিন্দারা আমাদের উদ্ধার করেছেন। রক্তিপাড়া জামে মসজিদের ইমাম আমাকে নাস্তাও করিয়েছেন।

সংবাদ পেয়ে মধুপুর থানা-পুলিশ তাঁদের উদ্ধার করে থানায় নিয়ে আসে। গাড়িতে থাকা দেশীয় অস্ত্র উদ্ধারের কথা স্বীকার করেছেন মধুপুর থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) এনামুল হক। বিকেল ৫টায় ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, ডিবি পুলিশের একটি দল তদন্তকাজ চালাচ্ছে। পুলিশের সহযোগিতায় একদল উদ্ধারকর্মী বাসটি উদ্ধার করছেন। টাঙ্গাইলের পুলিশ সুপার সরকার মোহাম্মদ কায়সার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে থানায় এসে বাসযাত্রী ও সংশ্লিষ্টদের জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন। এ সময় ময়মনসিংহ থেকে আসা ডিএনএ পরীক্ষাগারের কর্মীদের থানায় অবস্থান করতে দেখা গেছে।

এ ব্যাপারে মধুপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ মাজহারুল আমিন বলেন, ঘটনাটি তদন্তাধীন। বাসের এক যাত্রী বাদী হয়ে মামলা করবেন বলেও জানিয়েছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published.


The reCAPTCHA verification period has expired. Please reload the page.