নিজস্ব প্রতিবেদক :
সদ্য ঘোষিত ঢাকা মহানগর বিএনপির উত্তর ও দক্ষিণের আহ্বায়ক কমিটি নিয়ে নেতাকর্মীদের মধ্যে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে। পদ হারানো কিংবা বহিষ্কার আতঙ্কে কেউ প্রকাশ্যে মুখ খুলছেন না। তবে দলটির হাইকমান্ডসহ নীতিনির্ধারকদের কাছে অনেকে তাদের ক্ষোভের কথা জানাচ্ছেন। দীর্ঘদিন মহানগর রাজনীতি করে পদ না পাওয়ায় কেউ স্বেচ্ছায় নিষ্ক্রিয় থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
এমন পরিস্থিতিতে নেতাকর্মীদের ক্ষোভ নিরসনের কথা ভাবছে হাইকমান্ড। যারা মহানগর রাজনীতিতে দীর্ঘদিন সক্রিয় তাদের নতুন কমিটিতে ‘কো-অপ্ট’ করা হতে পারে। তবে বর্তমান কমিটি এবং দলের একটি অংশ এ উদ্যোগের বিরোধিতা করছে। এমন পরিস্থিতিতে দলের হাইকমান্ড দোটানায় পড়েছেন।
বাদপড়া সিনিয়রদের দিয়ে একটি উপদেষ্টা কমিটি করার পক্ষে কেউ কেউ মত দিয়েছেন। পাশাপাশি বিগত সিটি নির্বাচনে উত্তর ও দক্ষিণে বিএনপির মেয়র প্রার্থী তাবিথ আউয়াল ও ইঞ্জিনিয়ার ইশরাক হোসেনকে কমিটিতে ‘সাইনিং পাওয়ার’ দেওয়ার কথাও আলোচনা চলছে। এ উদ্যোগের বিরোধিতা করছে বর্তমান কমিটি এবং দলের একটি অংশ।
তাদের যুক্তি, যে কোনো কমিটি ঘোষণার পর নেতাকর্মীদের একটি অংশের মধ্যে ক্ষোভ থাকবেই। তাদের ক্ষোভ নিরসনে অন্য উপায় বের করতে হবে। ক্ষোভ নিরসনের অংশ হিসাবে তাদের কমিটিতে ‘কো-অপ্ট’ করা হলে তা হিতে বিপরীত হবে। তাবিথ ও ইশরাককে নতুন কমিটিকে ‘সাইনিং পাওয়ার’ দেওয়া হলে দলের শৃঙ্খলা ভেঙে পড়বে।
এছাড়া দলের গঠনতন্ত্রে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের বাইরে অন্য কাউকে ‘সাইনিং পাওয়ার’ দেওয়ার কোনো বিধানও নেই। কোনো বিশেষ ব্যক্তিকে প্রাধান্য দেওয়া হলে তা ভবিষ্যতে খারাপ দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। এমন পরিস্থিতিতে বিষয়টি নিয়ে দলের হাইকমান্ড পড়েছেন দোটানায়। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে রয়েছেন দ্বিধা-দ্বন্দ্বে।
২ আগস্ট ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ বিএনপির আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করা হয়। দক্ষিণে আব্দুস সালামকে আহ্বায়ক ও রফিকুল আলম মজনুকে সদস্য সচিব করে ৪৯ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি করা হয়েছে। উত্তরে ৪৭ সদস্যের কমিটিতে আমানউল্লাহ আমানকে আহ্বায়ক এবং সাবেক ফুটবলার আমিনুল হককে সদস্য সচিব করা হয়েছে।
এ ছাড়া ঢাকা সিটি করপোরেশনের দুই মেয়র প্রার্থী তাবিথ আউয়ালকে উত্তরে ও ইশরাক হোসেনকে দক্ষিণের কমিটিতে এক নম্বর সদস্য করা হয়েছে। সূত্র জানায়, ঢাকা মহানগর কমিটিতে শীর্ষ পদের জন্য নানা মাধ্যমে তদবির করেন ইশরাক। হাইকমান্ডের কাছে তিনি সদস্য সচিব হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেন। কিন্তু শেষ মুহূর্তে তাকে শুধু সদস্য করা হয়। এ নিয়ে তিনি চরম ক্ষুব্ধ হন। কমিটি ঘোষণার আগে হাইকমান্ডের পক্ষ থেকে তাকে জানানো হয়েছিল, শীর্ষ পদে না রাখলেও কমিটিতে তাদের দুজনকে (তাবিথ ও ইশরাক) সাইনিং পাওয়ার দেওয়া হবে।
কমিটি ঘোষণার আগে এমন সিদ্ধান্ত থাকলেও শেষ মুহূর্তে সেটাও করা হয়নি। শীর্ষ পদ এমনকি ‘সাইনিং পাওয়ার’ না পাওয়ায় ক্ষুব্ধ হয়ে লন্ডনের পথে পাড়ি জমান ইশরাক। বর্তমানে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে রয়েছেন। সেখান থেকে লন্ডনে গিয়ে তিনি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে দেখা করবেন।
নতুন কমিটিতে তাকে যাতে সাইনিং পাওয়ার দেওয়া হয় সে বিষয়ে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের কাছে অনুরোধ জানাবেন তিনি। বিষয়টি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান যাতে ইতিবাচকভাবে দেখেন সে ব্যাপারে দলের সিনিয়র কয়েকজন নেতাকে দিয়ে তাকে অবহিত করা হয়েছে। তারেক রহমানের সঙ্গে ইশরাকের বৈঠকের পরই এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানা যাবে।
সূত্র জানায়, ইশরাকের এমন মনোভাব বুঝতে পেরে মহানগরের বর্তমান কমিটি ও তাদের অনুসারীরা তৎপর হয়ে ওঠেন। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান যাতে এ দুজনকে কোনোভাবেই সাইনিং পাওয়ার না দেন সে ব্যাপারে তারা নানাভাবে চেষ্টা চালাচ্ছেন। সিনিয়র নেতাদের দিয়ে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানকে অবহিত করছেন। গঠনতন্ত্রের বাইরে গিয়ে এমন সিদ্ধান্ত নিলে দলে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলেও বার্তা পাঠানো হচ্ছে।
এদিকে বিগত কমিটিতে গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা মহানগরের কয়েকজন নেতা বাদ পড়েছেন। যারা কয়েক যুগ ধরে মহানগরের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। তাদের বাদ দেওয়ার ক্ষেত্রে নতুন কৌশল নেওয়া হয়েছে। হাইকমান্ডের কাছে তাদের বাদ দেওয়ার যুক্তি হিসাবে বলা হয়েছে- যারা কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটিতে আছেন কিংবা বিগত সময়ে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী ছিলেন তাদের নতুন কমিটিতে রাখা উচিত হবে না।
ওয়ার্ড ও থানা কমিটি গঠনে তারা প্রভাব বিস্তার করতে পারেন। ফলে যোগ্য ও ত্যাগী নেতারা বাদ পড়বেন। দলের নীতিনির্ধারকদের একটি অংশের এমন যুক্তি মেনে নেন হাইকমান্ড। বিগত কমিটিতে যারা কেন্দ্রীয় দায়িত্বে আছেন কিংবা সংসদ নির্বাচন করেছেন তাদের বাদ দেওয়া হয়। কিন্তু তাদের এ যুক্তি মেনে নিতে পারছেন না বাদপড়া নেতারা।
এ প্রসঙ্গে দক্ষিণে বাদপড়া নেতা শেখ রবিউল আলম রবি বলেন, কিছু নেতা দলের হাইকমান্ডকে ভুল বার্তা দিয়ে বিভ্রান্ত করছেন। যে যুক্তিতে তাদের বাদ দেওয়া হয়েছে সেটা সংগঠনের জন্য ইতিবাচক নয়। আমরা যারা দীর্ঘদিন ধরে মহানগরের রাজনীতি করছি তাদের অনেকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছি। যখন আমি নির্বাচনের মাঠে নামব তখন স্থানীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে আমাদের একটা সুসম্পর্ক থাকা উচিত। কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে আমাদের পরামর্শ নেওয়া হলে তা দলের জন্য ভালো হবে। কিন্তু যারা নির্বাচন করবেন তারা জানতেই পারবেন না কারা ওয়ার্ড কিংবা থানা কমিটিতে আসছেন, তাহলে কীভাবে তাদের নিয়ে কাজ করব। এ ধরনের পরামর্শ কারা দেয় বুঝতে পারছি না। তারা আসলে দলের কতটুকু ভালো চান তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।
নতুন কমিটিতে বাদপড়া উত্তরের সাবেক যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক কফিল উদ্দিন অনেকটা ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, সরকারি চাকরিতে যেমন অবসরের সময়সীমা রয়েছে, তেমনি রাজনীতিতেও মনে হয় সে নিয়ম রয়েছে। দীর্ঘ ৩৫ বছর ধরে বিএনপির রাজনীতি করছি। মনে হচ্ছে আমাদের অবসরের সময় হয়ে গেছে। তাই হাইকমান্ড আমাদের বাদ দিয়ে নতুনদের চাকরিতে যোগদান করিয়েছে। তিনি বলেন, কমিটিতে বাদপড়ার বিষয়টি দলের নীতিনির্ধারকদের অবহিত করেছি। দেখি তারা কি সিদ্ধান্ত নেয়। এরপর আমি আমার সিদ্ধান্ত জানাব।
উত্তরে আগের কমিটির সাধারণ সম্পাদককে রাখা হলেও বাদ দেওয়া হয়েছে দক্ষিণের সাধারণ সম্পাদক কাজী আবুল বাশারকে। জানতে চাইলে কাজী আবুল বাশার বলেন, বিএনপি প্রতিষ্ঠার পর দলের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। দীর্ঘকাল মহানগরীর রাজনীতিই করেছি। বিগত প্রতিটি কমিটিতে কোনো না কোনো পদে ছিলাম। কিন্তু এবার রাখা হয়নি। কেন রাখা হয়নি তাও জানি না। হয়তো হাইকমান্ড মনে করেছে-আমাদের দিয়ে আর হবে না। কাজী বাশার আরও বলেন, দীর্ঘদিন আমরা মহানগরের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলাম। নতুন কমিটি গঠনের আগে আমাদের মতামতও নেওয়া হয়নি। গণমাধ্যমের মাধ্যমে জানতে পেরেছি নতুন কমিটি হচ্ছে।
বিএনপির কয়েকজন নীতিনির্ধারক জানান, ঘোষিত কমিটিতে বাদপড়াদের কো-অপ্ট করার সুযোগ নেই। কারণ যারা বাদ পড়েছেন তাদের প্রায় সবাই কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য কিংবা বিগত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী ছিলেন বা মনোনয়নপ্রত্যাশী। দুকমিটিতে যারা যুগ্ম-আহ্বায়ক আছেন তাদের বেশির ভাগই কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটিতে পদ নেই। বাদপড়াদের পরে পদ দেওয়া হলে সেটা ভালো হবে না। কিংবা তারাও মেনে নেবেন না। তাই তাদের বিকল্পভাবে রাখা যায় কিনা সে আলোচনা চলছে।
কেউ কেউ মনে করছেন, যারা বাদ পড়ছেন তাদের দিয়ে ছোট পরিসরে একটা উপদেষ্টা কমিটি করা যেতে পারে। সেটা হলে বাদপড়াদের একটা সম্মান দেওয়া হবে। পাশাপাশি তাদের ক্ষোভও নিরসন হবে। তবে বর্তমান কমিটি এবং দলের বড় একটি অংশ এ উদ্যোগের বিরোধিতা করছেন। তাই শেষ মুহূর্তে এ উদ্যোগ বাস্তবায়ন হবে কিনা তা নিয়েও সংশয় রয়েছে।
জানতে চাইলে সদ্য ঘোষিত ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির সদস্য সচিব আমিনুল হক বলেন, কমিটি নিয়ে কারও মধ্যে কোনো ক্ষোভ নেই। যারা কমিটিতে আছেন কিংবা বাদ পড়েছেন সবার মত নিয়ে ওয়ার্ড ও থানা কমিটি করা হবে। ১৬ আগস্ট থেকে আমরা সাংগঠনিক কাজ শুরু করব। তিনি বলেন, নতুন কমিটিতে কাউকে “কো-অপ্ট” করা কিংবা “সাইনিং পাওয়ার” দেওয়ার বিষয়টি সম্পূর্ণ গুজব। এ ধরনের কোনো চিন্তা হাইকমান্ডের নেই বলে আমরা জানতে পেরেছি।