বগুড়ায় ট্রাফিক পুলিশের মাসিক টোকেন বাণিজ্যের অভিযোগ চরমে

অপরাধ

মাসিক টোকেন না থাকলেই বিভিন্ন অজুহাতে মামলা আর হয়রানিতে দিশেহারা যানবাহন সংশ্লিষ্টরা

এম শাহীন আলম ও মতিন খন্দকার টিটু :
রাজধানী ঢাকার পর উত্তর বঙ্গের লাইফ লাইন খ্যাত রাজধানী বগুড়ায় ছোট,মাঝারি,বড় সহ প্রায় সকল ধরনের যানবাহন থেকে মাসিক টোকেনে কর্মরত টিআই ও সার্জেন্টদের সরাসরি এবং বিভিন্ন পরিবহন মালিক শ্রমিক সংগঠনের ছত্র-ছায়ায় ঘুষ বাণিজ্যে মেতে উঠার অভিযোগ বগুড়ার ট্রাফিক পুলিশের বিরুদ্ধে। এছাড়া গাড়ি রিকুইজিশন আর রেকার বিলের নামে হয়রানি ও ঘুষ বানিজ্যও চরমে। চাহিদা অনুযায়ী ঘুষ বানিজ্য তো প্রতি দিনের রুটিনে পরিণত হয়েছে বগুড়ার প্রতিটি মোড় এবং স্ট্যান্ডে, কর্মরত টিআই এবং সার্জেন্টরা আছেন ক্যাশিয়ারের মূল ভূমিকায় তাৎক্ষণিক টাকা দিলে রেহাই,চাহিদা অনুযায়ী টাকা না দিলে বিভিন্ন ধারায় মামলা দেওয়ার অভিযোগ অহরহ।বগুড়ার ট্রাফিক পুলিশের টিআই এবং সার্জেন্টরা প্রতি দিনের ডিউটির পাশাপাশি বিভিন্ন অজুহাতে রাস্তায় গাড়ি আটক রেখে ব্যতিব্যস্ত নিজেদের পকেট ভরার কাজে । ট্রাফিক বিভাগকে আধুনিকায়ণ করা করা হলেও, সাথে সাথে অনিয়মের পদ্ধতিও বদলে যাচ্ছে । এছাড়া বগুড়া ট্রাফিকের বিরুদ্ধে এমন-ই ডিজিটাল অনিয়ম আর ঘুষ বাণিজ্যের অভিযোগও উঠেছে চরমে।

সরেজমিন অনুসন্ধানে স্হানীয় সূত্র মতে জানা যায় , যখন যে টিআই ওয়ানের দ্বায়িত্ব পান তার প্রতিমাসে টিআই ওয়ানের (প্রশাসনের) মাসিক নিজস্ব আয় লাখ লাখ টাকা, সাথে রয়েছে ঊর্ধ্বতন কর্তাদের কমিশন। ফলে লোভনীয় পদে বসতে চলে বড় রকমের দেনদরবারও।

প্রত্যেক এডমিন তার নিজস্ব পছন্দের মানুষ দিয়ে চালান তাদের অনিয়ম দুর্নীতি আর ঘুষ বাণিজ্য। এরই মধ্যে বগুড়ার ট্রাফিক ব্যবস্থার উন্নত না হলেও নিজেদের পকেট ভরতে ব্যস্ত সময় পার করেন ট্রাফিক পুলিশের সিন্ডিকেট।

গাড়ি মালিক ও শ্রমিক সমিতিসহ শহরে চলাচল করা সব ধরনের যানবাহন থেকেই উঠানো হচ্ছে মাসিক টোকেন মাসোহারা। বগুড়া ট্রাফিক বিভাগ গাড়ির মালিক ও শ্রমিকরা হয়রানি থেকে বাঁচতে ও জরিমানার ভয়ে নিজ থেকেই যোগাযোগ করেন ট্রাফিক অফিসের দ্বায়িত্বে নিয়োজিত দুর্নীতিবাজ কর্তা ব্যক্তিদের সাথে।

এদিকে মাসোহারার টোকেন বাণিজ্য রমরমা’র সাথে যোগ হয়েছে “ভুয়া কেস স্লিপ”। বর্তমান টিআই ওয়ানের দ্বায়িত্বে আছেন মো.হাবিবুর রহমান। মুলহোতা অঘোষিত ক্যাশিয়ারের দ্বায়িত্ব পালন করছেন তার ঘনিষ্ঠ এক পরিদর্শক।তিনি যোগদানের পর থেকেই জেলা শহর ও বিভিন্ন উপজেলার বালু মহলের ট্রাক মালিক, বাস মালিক সমিতি, সিএনজি, অটোরিকশা, ট্রান্সপোর্টসহ বগুড়া জেলার সকল রাস্তায় চলাচলকৃত সব ধরনের মালিক শ্রমিকদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন তিনি।

সচেতন স্হানীয় লোকজন বলছেন, বগুড়ায় ট্রাফিক পুলিশের এই টোকেন মাসোহারার কারণে সরকার বিপুল পরিমানে রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। ফিটনেসবিহীন গাড়ী চলাচল করায় সড়কে বাড়ছে দুর্ঘটনা, প্রতিনিয়ত ঘটছে প্রাণহানি। শহরজুড়ে অনুমোদনহীন গাড়ির ছড়াছড়ি থাকলেও ট্রাফিক পুলিশ পড়ে আছে মোটরসাইকেল,অটোরিকশা আর সিএনজির পেছনে।

আরো জানা যায়, জনসাধারণ ও সরকারকে দেখানোর জন্য কিছু মামলা দিয়ে রাজস্ব আয় দেখানো হলেও প্রকৃতপক্ষে তারা ব্যস্ত আছেন মাসিক টোকেন আর আটক বাণিজ্য নিয়ে।

সরেজমিনে অনুসন্ধানে বগুড়ার ছোট বড় পরিবহনের সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা যায়, বর্তমান টিআই প্রশাসন যোগদানের পর থেকে বগুড়ার জেলা এবং সকল উপজেলায় চলাচলরত বেশিরভাগ যানবাহন মাসিক টোকেনে ঘুষ বানিজ্য ছাড়া রাস্তায় চলাচল করা মুসকিল। বিভিন্ন যানবাহনের চালকদের সাথে কথা বললে তারা জানান,গাড়ির কাগজপত্র না থাকলেও মাসিক টোকেনের মাধ্যমে গাড়ি চালাতে তেমন সমস্যা হয় না কিন্তু গাড়ির সকল কাগজপত্র ঠিকঠাক থাকলেও ট্রাফিক পুলিশের মাসিক টোকেন চাঁদা না দিলেই বিভিন্ন অজুহাতে গাড়ি আটক করে মামলা দিয়ে দেওয়ার অভিযোগ অহরহ। আবার ড্রাইভারদের অনেকেই আক্ষেপ করে বলেন, আমরা ট্রাফিক পুলিশকে মাসিক টোকেনের মাধ্যমে টাকা দিলেও প্রায় সময় টাকা দেওয়ার পরও বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে গাড়ি আটক রেখে মামলার শিকারও হতে হয়,গাড়ি সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য অনুযায়ী বর্তমান টিআই প্রশাসন যোগদানের পর থেকেই বগুড়ার ট্রাফিক পুলিশে কর্মরতরা একেবারে বেপরোয়া,তারা টাকা ছাড়া কিছুই বুঝতে চায় না।আর তাদের চাহিদা অনুযায়ী টাকা দিলেই সব কিছু বৈধ হয়ে যায়।

অনুসদ্ধানে আরো জানা যায়, সিএনজি, ট্রাক, বাস, মালিক সমিতি ও শ্রমিক ইউনিয়নগুলোর থেকে মাসিক মোটা অংকের টাকা তোলেন বগুড়ার ট্রাফিক প্রশাসন। মাসে লাখ লাখ টাকা চাঁদা উঠানো হয় বিভিন্ন খাত থেকে। অন্যদিকে দূরপাল্লার বাস কাউন্টার, দিনের বেলায় শহরে চলাচলরত ইট-বালু বহনকারী ট্রাক মালিকদের কাছ থেকেও নেওয়া হয় মাসিক চাঁদা। বাদ যায়না ব্যাটারি চালিত রিক্সা ও অটোরিকশাও। জেলা ও বিভিন্ন উপজেলায় চলাচলকারী অবৈধ ভুটভুটি, নছিমন করিমন আটক করে আদায় করা হয় মোটা অংকের টাকা। এছাড়াও ট্রাফিক অফিসে কর্মরতদের সাথে যোগসাজশ করে কিছু সোর্স নামের দালালরা রাস্তায় আটককৃত ট্রাক, বাস, সিএনজিসহ বিভিন্ন ছোট বড় যানবাহনের দেনদরবার করে মোটা অংকের ঘুষ নিয়ে ছেড়ে দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে। আর এদের দেনদরবারে সহযোগিতা করেন প্রসিকিউশন শাখার কর্তব্যরতরা।

বর্তমানে ট্রাফিক বিভাগে ডিজিটাল নিয়মে সরাসরি মামলার জরিমানার টাকা জমা দেওয়া হয় ব্যাংকে। এতে কিছুটা অনিয়ম বন্ধ হলেও নকল কেস/মামলার স্লিপে চলে অনৈতিক ঘুষ বাণিজ্য চরমে। এখনো ডিজিটাল মেশিনে মামলা না নিয়ে মেন্যুয়ালি নকল বা জব্দ তালিকা মুলে গাড়ি ধরা হয়। অনেক সময় নকল (বৈধ নয় এমন) কেস স্লিপ ব্যবহার করা হচ্ছে। গাড়ি জব্দের কেস স্লিপের অপব্যবহার বেশি করা হচ্ছে। বগুড়া জেলা ট্রাফিক বিভাগের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই বিভাগের কয়েকজন বলেন সবাইকে ম্যানেজ করে সব চলে। আর বড় কর্তাদের নির্দেশ ছাড়া ট্রাফিক বিভাগে কারো কিছু করার ক্ষমতা থাকেনা।

অনুসন্ধানে জানা যায়,জেলার বিভিন্ন উপজেলায় চলাচলরত কাগজপত্র বিহীন ড্রাম ট্রাক থেকেও নেওয়া হয় মাসোহারা। এভাবেই বিভিন্ন রকমের পরিবহন থেকে মাসোহারা তোলেন কর্তব্যরত টিআই এবং সার্জেন্টরা। বগুড়ার প্রতিটি মাইক্রোবাস থেকে নেওয়া হয় মাসোহারা। ভাড়ায় চালিত প্রাইভেটকার, হাইএস, মাইক্রোবাস স্ট্যান্ড থেকে নেওয়া হয় মাসোহারা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে টি আই (প্রশাসন) মো.মাহবুবুল ইসলাম খাঁন বলেন,মাসিক টোকেন আর অনিয়মের কথা শুনেছি, অনিয়মের বিরুদ্ধে ব্যবস্হা নিবেন বলে তিনি সংবাদ মাধ্যমকে আশ্বস্ত করেন। তিনি বলেন এখন ট্রাফিক বিভাগ চলে এসপি স্যারের তত্ত্বাবধানে।

এ বিষয়ে বগুড়া জেলা পুলিশের এ এসপি (ট্রাফক) বলেন,এসব অনিয়মের বিষয়ে আমার জানা ছিল না। আপনার কাছে অনিয়মের প্রমাণ থাকলে অফিসে নিয়ে আসবেন, আমি তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবস্থা নিবো। আমার অফিস শতভাগ পরিষ্কার আছে। বাহিরে কিছু অনিয়ম থাকলে তা তদন্ত পূর্বক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বগুড়া জেলা ট্রাফিক বিভাগের অনিয়মের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান অব্যাহত রয়েছে আরো বিস্তারিত ধারাবাহিক ভাবে ২য় পর্বে প্রকাশ করা হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published.


The reCAPTCHA verification period has expired. Please reload the page.