বিশেষ প্রতিবেদক :
বাংলাদেশে খুব শিগগিরই নিজস্ব অর্থায়নে এ পর্যন্ত নির্মিত সর্ববৃহৎ অবকাঠামো পদ্মা সেতুর উদ্বোধন হতে যাচ্ছে। টাকার অবমূল্যায়ন এবং প্রকল্পের নকশায় পরিবর্তনের জন্য নির্মাণ খরচ বেড়ে যাওয়া সত্বেও সফলভাবে এই সেতুর নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়েছে দেশীয় অর্থায়নে। বৃহৎ প্রকল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আর্থিক বিশ্লেষকরা বলেছেন, এই প্রকল্পের সর্বশেষ ব্যয় দাড়াচ্ছে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা, যদিও প্রকল্পের শুরুতে এর ব্যয় ধরা হয়েছিল ১০ হাজার ১৬২ কোটি টাকা।
সেতু বিভাগের একজন অর্থনৈতিক বিশ্লেষক টাকার অবমূল্যায়ন, সেতুর দৈর্ঘ্য বৃদ্ধি এবং সেতুর নীচ দিয়ে জাহাজ চলাচলের সুবিধাসহ এই প্রকল্পে রেল লাইনের সংযোজন ইত্যাদির উল্লেখ করে বাসসকে বলেন, ‘প্রকল্প ব্যয় বৃদ্ধির যৌক্তিক কারন রয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই কর্মকর্তা এ প্রকল্পের বিশ্লেষণ সম্বলিত নিজস্ব একটি হিসাব উপস্থাপন করেন। তার মতে ২০০৬ সালে প্রণীত প্রাথমিক ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট প্রপোজালে (ডিপিপি) প্রস্তাবিত কাঠামোয় নকশার বিস্তারিত বিবরন ছিল না।
এই তথ্য অনুযায়ী ওই ডিপিপি তিনবার সংশোধন করা হয়েছে। প্রথম ডিপিপিতে মূল সেতুর দৈর্ঘ্য ধরা হয়েছিল ৫.৫৮ কিলোমিটার, যা বর্তমানে হয়েছে ৬. ১৫ কিলোমিটার। সর্বনিম্ন নির্মাণ ব্যয়ের রেট দিয়ে যারা কাজ পেয়েছেন তাদের হিসাবে এই প্রকল্পে মূলত: মূল সেতু, সংযোগ সড়ক নির্মান ও নদী শাসন কাজে অতিরিক্ত ৮ হাজার টাকা ব্যয়ের কথা বলা হয়েছে।
প্রাথমিক ডিপিপিতে এই প্রকল্পে রেল লাইন স্থাপনের বিষয় ছিল না, তাছাড়া প্রাথমিক নকশায় কেবল মাত্র তিনটি স্প্যানের নীচ দিয়ে জাহাজ চলাচলের প্রস্তাব ছিল।এখন ৩৭ টি স্প্যানের নীচ দিয়েই জাহাজ চলাচল করার ব্যবস্থা রয়েছে। অর্থাৎ আগের নকশায় বিস্তারিত ইঞ্জিনিয়ারিং ডিজাইন ছিল না।
প্রাথমিক ডিপিপি খসড়া প্রণয়নকালে এক মার্কিন ডলারের সমান ছিল ৬৯.০১ টাকা। চূড়ান্ত নকশার খসড়া তৈরিকালে এক ডলারের বিপরীতে টাকার মান দাঁড়ায় ৭৮ টাকায়। ২০১১ সালে প্রথম ডিপিপি সংশোধন করে এ প্রকল্প ব্যয় বাড়িয়ে ২০,৫০০ কোটি টাকা করা হয়। ওই সময় এ সেতু তৈরির ক্ষেত্রে প্রায় ১০ কিলোমিটার রাস্তা তৈরির পাশাপাশি সেতুর দৈর্ঘ্য সম্প্রসারণ করা হয়।
এ রেলওয়ে সেতু দিয়ে যাতে অতিরিক্ত মালামাল বহন করা যায় তা মাথায় রেখে ট্রেনের ‘ডাবল স্ট্যাক কন্টেইনার’ নিয়ে যাতায়াতের সুযোগ রেখে রেল পথ অন্তর্ভূক্ত করে ২০১৬ সালে ডিপিপি দ্বিতীয় দফা সংশোধন করা হয়। ডিপিপি’র এ ধরনের সংশোধনের প্রয়োজন ছিল। আবারো প্রাক্কলন ব্যয়ের ওপর ভিত্তি করে এ প্রকল্পের ডিপিপি প্রণয়ন করা হয়। এ সেতুর ব্যয় কম রাখার লক্ষ্যে মার্কিন ডলারের বিপরীতে স্থানীয় মুদ্রার হার একই রাখা হয় (এক মার্কিন ডলার সমান ৬৯.১ টাকা)।
২০১৬ সালে এ প্রকল্পের ডিপিপি আবারো সংশোধন করে মোট ব্যয় ২৮,৭৯৩ কোটি টাকা (বিশেষ সংশোধনসহ মোট ব্যয় ৩০,১৯৩ কোটি টাকা) নির্ধারণ করা হয়। নদী শাসন করে অতিরিক্ত ১.৩ কিলোমিটার পথ অন্তর্ভুক্ত করায় এবং মার্কিন ডলারের বিপরীতে স্থানীয় মুদ্রার মান পড়ে যাওয়ায় এ ব্যয় নির্ধারণ করা হয়। ওই সময় মার্কিন ডলারের বিপরীতে স্থানীয় মুদ্রার বিনিময় হার ৬৯ টাকা থেকে বেড়ে ৭৮ টাকায় দাঁড়ায়। জমি অধিগ্রহণের ব্যয় ও পরিমাণ উভয় বেড়ে যায়। প্রাথমিকভাবে, এ প্রকল্পের জন্য ১,১২৪ হেক্টর জমি অধিগ্রহনে ব্যয় ধরা হয়েছিল ৯৪৪.৭২ কোটি টাকা। সংশোধিত এ ডিপিপিতে ২,৬৯৩.২ হেক্টর জমি অধিগ্রহনের কথা বলা হয় এবং ব্যয় ধরা হয় ১,৬১২ কোটি টাকা।
ফেরি ঘাট স্থানান্তরের জন্য এ প্রকল্পে অতিরিক্ত ব্যয় যোগ হয়।
প্রথম ডিপিপিতে নির্ধারিত প্রকল্প ব্যয়ের স্থলে উম্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে পাওয়া প্রকল্প ব্যয় চূড়ান্ত ডিপিপিতে অন্তর্ভূক্ত করা হয় (মূল সেতু, নদী শাসন ও সংযোগ সড়ক নির্মাণের জন্য সংশোধিত ডিপিপিতে অতিরিক্ত ৮,০০০ কোটি টাকা যোগ করা হয়।
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, নিরাপত্তা নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর নিরাপত্তা দল নিয়োগ ও যানবাহন সংগ্রহের জন্য এ প্রকল্পে অতিরিক্ত ব্যয় যুক্ত হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী ২৫ জুন বহুল প্রতীক্ষিত পদ্মা সেতু উদ্বোধন করবেন।