দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ান কুমেক হাসপাতালের আওয়ামী দোসর দেলোয়ার এখনো বহাল তবিয়তে

অপরাধ

বিশেষ প্রতিবেদক :
কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ (কুমেক) হাসপাতালের প্রধান সহকারি দেলোয়ার হোসেনের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং আধিপত্য বিস্তারের অভিযোগ উঠেছে। সাবেক এমপি বাহাউদ্দিন বাহারের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে পরিচিত দেলোয়ার, বিগত সরকারের আমলে তার প্রভাব খাটিয়ে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। দেলোয়ারের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে যে, তিনি নিজের পছন্দের ঠিকাদারদের কাজ পাইয়ে দিতে আন্ডারগ্রাউন্ড পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতেন, যা কখনোই পাঠকের হাতে পৌঁছাতো না। এই পদ্ধতিতে তিনি কমিশনের মাধ্যমে কাজ পাইয়ে দিতেন এবং অন্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নামে কাজ নিয়ে নিজেই সেই কাজ করতেন। কুমেকের প্রধান হিসাবরক্ষক হিসেবে তিনি সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীকে জিম্মি করে রেখেছিলেন। বর্তমানে, দেলোয়ার এখনও সাবেক আওয়ামী লীগ সরকারের নেতাদের কাজ পাইয়ে দিতে ব্যস্ত রয়েছেন। তার অফিসে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের ভীড় লক্ষণীয়। বিএনপির নেতা-কর্মীরা প্রতিবাদ জানানোর পর, দেলোয়ার কৌশল পাল্টে অফিসের বাইরে নিরাপদ স্থানে মিটিং করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া, বৈষম্য বিরোধী ছাত্রদের বিরুদ্ধে অর্থ যোগান ও সন্ত্রাসীদের লেলিয়ে দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। দেলোয়ারের অবৈধ পদোন্নতির বিষয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয়ে অভিযোগ করা হলেও, এখনো পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। দীর্ঘদিন একই স্থানে চাকরির সুযোগে তিনি নামে-বেনামে অঢেল সম্পদ ও অর্থবিত্তের মালিক হয়েছেন। ভুক্তভোগী কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তার বিরুদ্ধে তদন্তপূর্বক বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের হস্তক্ষেপের দাবি জানিয়েছেন। দেলোয়ার হোসেন ১৯৯২ সালে কুমেক হাসপাতালে ক্যাশিয়ার পদে চাকরিতে যোগদান করেন। চাকরিবিধি অনুযায়ী এ পদ থেকে তার অন্য কোনো পদে পদোন্নতির সুযোগ নেই। তবে, প্রভাব খাটিয়ে তিনি প্রধান সহকারি পদে পদোন্নতি পেয়েছেন। ২০১৪ সালের ১৩ নভেম্বর, চাকরিবিধি লঙ্ঘন করে তাকে ক্যাশিয়ার পদ থেকে প্রধান সহকারি পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়। প্রধান সহকারি হলেও, তিনি প্রভাষ খাটিয়ে অঘোষিতভাবে হাসপাতালের কুমেক হাসপাতালের পরিচালক দেলোয়ার হোসেন হিসাবরক্ষক ও ক্যাশিয়ার পদে দায়িত্ব পালন করেন।

অভিযোগ রয়েছে, তিনি প্রায় পাঁচ বছর হাসপাতালের ডক্টরস কোয়ার্টার ব্যবহার করেছেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তদন্তে তার বিরুদ্ধে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণিত হলেও দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ২০১৯ সালের ১৭ নভেম্বর, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন) স্বাক্ষরিত বিভাগীয় মামলার অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, দেলোয়ার হোসেন ১৯৮৫ সনের নিয়োগবিধি লঙ্ঘন করে প্রধান সহকারি পদে পদোন্নতি পান। প্রতি অর্থ বছরে বিভিন্ন খাত হতে ভুয়া বিল-ভাউচারের মাধ্যমে তিনি প্রায় ৩০ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেন। তিনি হাসপাতালের কফি হাউজের বিদ্যুৎ বিলের টাকাসহ সিসি ক্যামেরা, এসি, কম্পিউটার ও ইন্টারকম মেরামত বাবদ লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেন। এ সময়ে তিনি প্রধান সহকারি হয়ে বিল ভাউচার তৈরী করা, হিসাবরক্ষক হয়ে ভাউচার পাশ করা ও ক্যাশিয়ার হয়ে টাকা উত্তোলন করাসহ তিনটি পদের দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়াও বিভি-ন্ন খাতে তিনি প্রায় ২ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেন। ২০২০ সালের ২২ অক্টোবর, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের প্রশাসন-১ অধিশাখার উপসচিব কর্তৃক প্রেরিত এক চিঠিতে দেলোয়ার হোসেনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় অথবা ফৌজদারি মামলা দায়েরসহ হাসপাতালের প্রশাসনিক ও আর্থিক কর্মকান্ড থেকে তাকে বিরত রাখার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়।

কিন্তু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। একই বছরে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর তার অনিয়ম-দুর্নীতি ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের প্রমাণ পেয়ে মার্চ তাকে চট্টগ্রাম বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে যোগদান করতে ৩ কার্যদিবস সময় বেঁধে দেন। এতে দেলোয়ার প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালে মামলা করে বদলির আদেশ স্থগিত করেন। ওই সময় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও তার বিরুদ্ধে কোনো ধরনের পদক্ষেপ নেয়নি। দীর্ঘ ২২ বছর একই প্রতিষ্ঠানে চাকরির সুযোগে দুর্নীতির মাধ্যমে তার নিজ জেলা শরিয়তপুর ও কুমিল্লার চাঁপাপুর এলাকায় ৯টি দলিলে কয়েক কোটি টাকার সম্পত্তি রয়েছে। এছাড়া হাউজিং এস্টেট এলাকায় দুদক কার্যালয়ের সন্নিকটে তার একটি বিলাসবহুল বাড়ি রয়েছে। কুমেক হাসপাতালের হিসাবরক্ষক আবুল খায়ের জানান, ‘আমাকে নানাভাবে হয়রানির মাধ্যমে দেলোয়ার হোসেন হিসাবরক্ষকের পদটি দীর্ঘদিন ধরে আঁকড়ে রেখেছিলেন। এতে আমি বিগত ৩১ মার্চ তার অবৈধ পদোন্নতির বিষয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ করে প্রতিকার চেয়েছিলাম। অভিযোগের প্রেক্ষিতে মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (প্রশাসন) শাখা-১ কর্তৃক গত ২৭ জুন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালককে (প্রশাসন) জরুরী ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য নির্দেশ দেন। কিন্তু এ পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

এসব অভিযোগের বিষয়ে কুমেক হাসপাতালের প্রধান সহকারি দেলোয়ার হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, আমাকে হয়রানির উদ্দেশ্যে ব্যক্তিস্বার্থে চার-পাঁচ বছর আগে নামে-বেনামে এসব মিথ্যা ও ভিত্তিহীন অভিযোগ করেছিল। বিভাগীয় ও অন্যান্য সংস্থার তদন্তে এসব অভিযোগের সত্যতা না পাওয়ায় সুরাহা হয়ে গেছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *


The reCAPTCHA verification period has expired. Please reload the page.