নিজস্ব প্রতিবেদক :
স্বাস্থ্যমন্ত্রী দুর্নীতি আমলে নিচ্ছেন না বলে অভিযোগ তুলেছেন জাতীয় সংসদের বিরোধী দলীয় উপনেতা গোলাম মোহাম্মদ (জিএম) কাদের। গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেন, স্বাস্থ্যখাতের অনিয়ম এখন দেশব্যাপী আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। কিন্তু দুর্নীতি নিরসনের কোন কার্যকর উদ্যোগ চোখে পড়ে না। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীসহ দায়িত্বপ্রাপ্তরা দুর্নীতির বিষয়টি আমলে নিচ্ছেন বলে মনে হয় না। অভিযোগগুলো গুরুতর। দেশবাসী আশা করে বিষয়টি গুরুত্বের সাথে নিয়ে যথাযথ তদন্ত হবে ও দোষীদের শাস্তির আওতায় আনা হবে।
মঙ্গলবার সংসদে ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের ওপর সাধারণ আলোচনায় অংশ নিয়ে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের এসব কথা বলেন। এর আগে সকালে স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে সংসদের বৈঠক শুরু হয়।
স্বাস্থ্যখাতের বরাদ্দের সমালোচনা করে জিএম কাদের বলেন, বাজেটে স্বাস্থ্যখাতের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে ৩২ হাজার ৭৩১ কোটি টাকা। যা চলতি অর্থ বছরের চেয়ে তিন হাজার ৪৮৪ কোটি টাকা বেশি। কিন্তু জিডিপির হিসাবে শূন্য দশমিক ৯৫ শতাংশ। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) সুপারিশ অনুযায়ী স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ হওয়া উচিত কমপক্ষে জিডিপির ৫ শতাংশ। সেখানে গত ১২ বছরে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ ছিল জিডিপির ১ শতাংশের নীচে।
তিনি বলেন, বাজেটে কোভিড-১৯ এর টিকা প্রয়োগের কথা বলা হলেও আমদানির জন্য এ খাতে আলাদা কোন অর্থ বরাদ্দের উল্লেখ নেই। তবে বাজেট বক্তৃতায় কিছু দেশ ও সংস্থার কাছ থেকে ভ্যাকসিন সরবরাহ এবং ভ্যাকসিন ক্রয়ের অর্থ প্রাপ্তির আশ্বাস উল্লেখ করা আছে। ভ্যাকসিন খাতে যথেষ্ট অর্থ বরাদ্দ রাখতে হবে।
জিএম কাদের বলেন, বর্তমান বিশ্বে প্রতিটি দেশ করোনা ভাইরাস প্রতিরোধের অস্ত্র হিসাবে ভ্যাকসিন ব্যবহার করছে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ অনুযায়ী প্রতিটি দেশের ৮০ শতাংশ জনসাধারণকে ভ্যাকসিনের আওতায় আনা গেলে জীবনযাত্রা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে। সে লক্ষ্যে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। অনেক দেশ যথেষ্ট সফলতাও পাচ্ছে। আমাদের দেশে ভ্যাকসিন সংগ্রহ এখন পর্যন্ত প্রকৃত অর্থে সুনির্দিষ্ট ও সুনিশ্চিত বলা যায় না। ফলে ভ্যাকসিন দেয়ার কাজ পুনরায় শুরু ও শেষ কিভাবে ও কবে হবে কেউ জানে বলে মনে হয় না।
করোনাভাইরাসের টিকা দেশে উৎপাদনে সরকারি প্রতিষ্ঠান অসহযোগিতা করছে অভিযোগ তুলে জিএম কাদের বলেন, অনেক দেশের মতো আমাদের দেশেও একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ভাকসিন তৈরিতে বেশ কিছু সাফল্য দেখিয়েছেন বলে গণমাধ্যমের খবরে জানা যায়। কিন্তু সরকারি সংশ্লিষ্ট নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার অসহযোগিতার অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। যাতে করে সে উদ্যোগটি মুখ থুবড়ে পড়ার উপক্রম হয়েছে।
প্রস্তাবিত বাজেটে সুশাসনের ব্যতয়ের সুযোগ রাখা হয়েছে উল্লেখ করে জিএম কাদের বলেন, যতই অর্থ বরাদ্দ দেয়া হোক সুশাসন না থাকলে দুর্নীতি, অপচয় ও সমন্বয়হীনতার কারণে বাজেট বাস্তবায়ন সম্ভব হয় না। সুশাসন না থাকলে অর্থ বরাদ্দের সুফল যাদের উদ্দেশ্যে বরাদ্দ দেয়া হয় তারা লাভ করেন না। এক কথায় সুশাসন ছাড়া বাজেট তৈরি ও বাস্তবায়ন সম্পূর্ণ অর্থহীন। বাজেটের উদ্দেশ্য জীবন মানের উন্নয়ন। শান্তি, স্বস্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ছাড়া মানুষের জীবনমান উন্নয়ন সম্ভব হয় না। সুশাসনের মাধ্যমেই সেটা সম্ভব। এ বিষয়ে বাজেটে কোন দিক নির্দেশনা নেই। বরং সুশাসনে ব্যত্যয়ের সুযোগ বাজেটে রাখা হয়েছে।
তিনি বলেন, কালো টাকা সাদা করার যে সুযোগ রাখা হয়েছে সেটা দুর্নীতিকে বৈধতা দেয়ার শামিল, এটি সুশাসনের পরিপন্থী। এ বিষয়টি নিশ্চিতভাবে দুর্নীতিকে উৎসাহিত করবে। যে কারণে এ সুযোগ রাখা হয়েছে বলা হয় সেটা হল দেশে বিনিয়োগবৃদ্ধি ও বিদেশে টাকা পাচার বন্ধ করা। বেশ কয়েকটি বাজেটে কিছু দিন থেকে এ সুযোগ দেয়া হয়ে আসছে। ফলাফল শূন্য।
বিরোধী দলীয় উপনেতা বলেন, বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট গত পাঁচ বছরে এক হাজার ২৪টি অর্থ পাচারের ঘটনার প্রমাণ পেয়েছে। বিএফআইইউ সরকারের বিভিন্ন সংস্থার কাছে অর্থ পাচারের সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য তথ্যপ্রমাণ সহ প্রতিবেদন পাঠিয়েছ। ফলাফল এখন পর্যন্ত কারো বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে এমন কোন তথ্য নেই।
ব্যাংকিং খাতের সমালোচনা করে বিরোধী দল জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান বলেন, ব্যাংকিং ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো অত্যন্ত নাজুক অবস্থার মধ্য দিয়ে চলছে। বাংলাদেশ ব্যংকের রিপোর্ট অনুযায়ী খেলাপি ঋণের পরিমান এক লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা। বংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি, হলমার্কের চার হাজার কোটি টাকা অর্থ লোপাট, বিসমিল্লাহ গ্রুপের আর্থিক অনিয়ম এবং বেসিক ব্যাংকের অনাদায়ী খেলাপি ঋণ উদ্ধারের বিষয়ে কোন কার্যকরী পদক্ষেপ এখনও দৃশ্যমান নয়। ২০১৮-২০২১ এই স্বল্প সময়ে ৫৯ হাজার ৪৬৬ কোটি টাকার অনিয়ম চিহ্নিত করেছে সরকারি প্রতিষ্ঠান কম্প্রোট্রোলার এন্ড অডিটর জেনারেল (সিএজি)। তাদের তথ্য মতে এ পর্যন্ত ঘটে যাওয়া আর্থিক অনিয়মের ৫২ দশমিক ১৮ শতাংশই হচ্ছে রাষ্ট্রায়ত্ব বাণিজ্যিক ও বিশেষায়িত ব্যাংকিং খাতের। যার পরিমাণ ৩১ হাজার কোটি টাকা। খেলাপী ঋণ না দেখিয়ে তা মুছে ফেলার সক্রিয় প্রয়াস চলছে। খেলাপি ঋণ বাড়লেও অনিয়মের মাধ্যমে সেটা লুকিয়ে ফেলা হচ্ছে। ব্যাংকিং খাতের মোট ঋণের ৪০ শতাংশই হচ্ছে খেলাপি ঋণ।
বিরোধী দলীয় উপনেতা বলেন, বিগত ১০ বছরে ব্যাংকিং খাতের অবস্থা খারাপের দিকে গেছে। এর প্রধান কারণ হচ্ছে, বিগত সময়ে আর্থিক অনিয়মের ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। দায়ীদের বিরুদ্ধেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। যে কারণে অনিয়মের পরিমাণ আগের তুলনায় বেড়েছে। তবে দায়ীদের বিচারের আওতায় আনা না হলে ভবিষ্যতে আর্থিক অনিয়মের পরিমাণ আরো বাড়বে। এই অনিয়ম রোধে সুস্পষ্ট কোন দিক নির্দেশনা বাজেটে পরিলক্ষিত হয়নি।