বিশেষ প্রতিনিধি :
র্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ন, র্যাব এলিট ফোর্স হিসেবে আত্মপ্রকাশের সূচনা লগ্ন থেকেই বিভিন্ন ধরনের অপরাধ নির্মূলের লক্ষ্যে অত্যন্ত আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার সাথে কাজ করে আসছে। সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ নির্মূল ও মাদকবিরোধী অভিযানের পাশাপাশি শীর্ষ প্রতারকদের গ্রেফতারসহ সাধারণ জনগণকে রক্ষা করার জন্য র্যাবের জোড়ালো তৎপরতা অব্যাহত আছে।
চাকুরী দেওয়ার নামে অর্থ আত্মসাৎ এর ঘটনা পুরাতন হলেও মানবাধিকার সংস্থার চেয়ারম্যান হিসেবে পরিচয় প্রদানকারী শাহীরুলের প্রতারনার ইতিহাস নিসন্দেহে ধৃষ্টতাপূর্ন এবং ভিন্নধর্মী। শাহীরুল একজন শীর্ষ পর্যায়ের প্রতারক। হোমল্যান্ড সিকিউরিটি এন্ড গার্ড সার্ভিস লিঃ কোম্পানী খুলে, ক্ষমতাধর ব্যক্তি হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন ও চাকুরী প্রদানের নামে প্রতারনা এবং বিত্ত বৈভবের মালিক শাহীরুল ছিল সকলের ধরা ছোঁয়ার বাইরে।
সম্প্রতি জনৈক সোলায়মান হোসেনসহ বেশকয়েকজন ভুক্তভোগী প্রতারক শাহিরুল ইসলাম সিকদার (৪৮) এর বিরুদ্ধে র্যাব-৪ এর নিকট চাকুরী দেওয়ার নামে প্রতারণার বিষয়ে অভিযোগ দায়ের করেন।
প্রাপ্ত অভিযোগের ভিত্তিতে র্যাব-৪ এর একটি গোয়েন্দা দল ছায়া তদন্ত শুরু করে। গোপন তদন্তে ও স্থানীয়ভাবে প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায় অভিযুক্ত শাহিরুল নিজেকে একটি কথিত মানবাধিকার সংস্থার চেয়ারম্যান এবং “হোমল্যান্ড সিকিউরিটি এন্ড গার্ড সার্ভিস লিমিটেড” নামক ভুয়া প্রতিষ্ঠান এর ব্যাবস্থাপনা পরিচালক। চাকুরী দেওয়ার নামে মিথ্যা প্রলোভন দেখিয়ে সাধারন মানুষের নিকট থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করে আসছে প্রতারক শাহীরুল। প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে গত ২২ অক্টোবর ২০২১ ইং তারিখ রাত ০০.৪০ ঘটিকা হতে ২৩ অক্টোবর ২০২১ ইং সকাল ০৮.৩০ ঘটিকা পর্যন্ত রাজধানীর রামপুরা থানাধীন বনশ্রী এলাকায় তার নিজ বাসা ও প্রতিষ্ঠানে অভিযান পরিচালনা করে শাহীরুল ইসলাম সিকদার (৪৮), জেলা- ব্রাক্ষহ্মণবাড়িয়া’কে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয় র্যাব-৪ এর একটি চৌকস আভিযানিক দল।
অভিযান পরিচালনাকালে প্রতারণা ও তার নিজ কর্ম হাসিলের কাজে ব্যবহৃত বিভিন্ন সামগ্রী যেমন-০৩ টি বিদেশী পিস্তল, ০১ টি শর্টগান ০১ টি এয়ারগান, ০১ টি এয়ার রাইফেল, ২৩৭ রাউন্ড গুলি, ০৫ টি ম্যাগাজিন, ০৫ টি খালি খোসা, ২২ টি কার্তুজ, ০৪ টি চাকু, ০১ টি লোহার স্টিক, ০৩ টি ডামি পিস্তলসহ হোমল্যান্ড সিকিউরিটি এন্ড গার্ড সার্ভিস লিমিটেড এর মাধ্যমে চাকুরির আবেদন ফরম, চুক্তিপত্র, বিভিন্ন ব্যাংকের চেক বই, ব্যানার, প্যাড, স্ট্যাম্প, ল্যাপটপ, ডেক্সটপ, গোপন ক্যামেরা, পাসপোর্ট, ভিজিটিং কার্ড, আইডি কার্ড, নেইম প্লেট, বিভিন্ন নামীদামী ব্যক্তিবর্গের সাথে তোলা ছবি, বুলেট প্রুফ জ্যাকেট, পাসপোর্ট, মানি রিসিভ বহি, বিভিন্ন ব্যাংকের এটিএম কার্ড, মোবাইল ফোনসহ বিভিন্ন মালমাল জব্ধ করা হয়।
প্রতারক শাহিরুলের উত্থান :
উচ্চ মাধ্যমিক পাশ শাহীরুল (৪৮), নিজ জেলা- ব্রাহ্মনবাড়িয়া, কর্মজীবন শুরু করে গাড়ি ব্যবসা দিয়ে। ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত সৌখিন পরিবহনে কাজ করে বলে জানা যায়। এরপর শুরু হয় নতুন ব্যবসা প্রতারণা। ২০০৩ সাল হতে শুরু করে সিকিউরিটি গার্ড সরবরাহ। এরপর ধীরে ধীরে হোমল্যান্ড সিকিউরিটি সার্ভিস লিঃ এর নামে শুরু হয় প্রাতিষ্ঠানিক প্রতারণা।
২০১৪ সালের দিকে রামপুরা এলাকায় “হোমল্যান্ড সিকিউরিটি এন্ড গার্ড সার্ভিস লিমিটেড” নামক একটি প্রতিষ্ঠান খুলে প্রতারণামূলক কাজ দিয়ে নতুন ভাবে কর্মজীবন শুরু করে। অতি অল্প সময়ে অধিক টাকার মালিক হওয়ার লোভে সে উক্ত কোম্পানীর নামে প্রতারণামূলক ভাবে অগণিত মানুষের নিকট হতে বিপুল পরিমান টাকা আত্মসাৎ করে আসছিল। এরপর থেকে শাহীরুল ইসলাম অবৈধ সম্পদের মালিক হতে শুরু করে।
একসময় প্রতরণার নানান অভিযোগ আড়াল করতে শাহীরুল তার অফিসের ঠিকানা পরিবর্তন করে। হোমল্যান্ড সিকিউরিটি সার্ভিস লিঃ এর পরিবর্তে নিজেকে প্রভাবশালী হিসেবে প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে একটি বেনামী মানবাধিকার সংস্থার চেয়ারম্যান হিসেবে পরিচয় দিয়ে থাকে। ক্ষমতা প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে সে নামিদামি ব্যক্তিবর্গের সাথে ছবি তুলে সেগুলো প্রদর্শন করে এবং বিভিন্ন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার নাম রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করে। গ্রেফতারকৃত আসামী তার প্রতারণার মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের বেকার ও শিক্ষিত বহু নারী ও পুরুষকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সিকিউরিটি গার্ড, ড্রাইভার, কম্পিউটার অপারেটর, অফিস সহকারী, বিক্রয় কর্মকর্তা, লাইনম্যান ইত্যাদি হিসেবে চাকুরী দেওয়ার নাম করে বিপুল পরিমান টাকা আত্মসাৎ করে বলে জানা যায়।
প্রতারনার কৌশল :
প্রতারক শাহীরুল (৩৮) বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সিকিউরিটি গার্ড নিয়োগ প্রদানের লক্ষ্যে চাকুরীর চটকাদার বিজ্ঞাপন দিত। দেশের শিক্ষিত বেকার তরুণ-তরুণীরা বিজ্ঞাপনে আকৃষ্ট হয়ে আবেদন করলে তাদেরকে কৌশলে ভূল বুঝিয়ে তার পরিচালিত কোম্পানীর মাধ্যমে নিয়োগ প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রতি চাকুরী প্রার্থীর কাছ থেকে ১৫-২৫ হাজার টাকা জামানত হিসেবে গ্রহন করতো। এবং সরকারী প্রতিষ্ঠানের চাকুরীর ক্ষেতে ৫-১০ লক্ষ টাকা গ্রহন করত। সে নিজেকে শুটিং ক্লাবের সদস্য বলে পরিচয় দিত। এছাড়া প্রশিক্ষণ, ইউনিফরম ও আনুসাঙ্গিক খরচ হিসেবেও টাকা নেয়া হতো। এভাবে অগণিত মানুষের কাছ থেকে টাকা নিয়ে নামমাত্র কয়েকজন’কে নিয়োগ প্রদান করে বাকি ভূক্তভোগীদের টাকা আত্মসাৎ করে শাহীরুল। দীর্ঘদিন তার অফিস/বাসায় ঘুরাঘুরির পরও চাকুরীতে নিয়োগ না পাওয়ার পর পাওনা টাকা ফেরত চাইলে তার কাছে থাকা অবৈধ অস্ত্র দিয়ে ভূক্তভোগীদের বিভিন্ন ভয়ভীতিসহ জীবননাশের হুমকি প্রদান করে। উল্লেখ্য যে, গ্রেফতারকৃত প্রতারক শাহিরুল নিজেকে একজন সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে ভূয়া পরিচয় প্রদান ও চাঁদাবাজি করার অপরাধে তার নামে ডিএমপি‘র রামপুরা থানায় চাঁদাবাজি ও প্রতারণার মামলা রয়েছে।
(ক) শাহীরুল নিজেকে হোমল্যান্ড সিকিউরিটি এন্ড গার্ড সার্ভিসেস লিঃ এর ব্যাবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে পরিচয় প্রদান করে বহু মানুষকে ভ‚য়া চাকুরীর নিয়োগপত্র দিয়ে অর্থ আত্মসাৎ করে।
(খ) মানবাধিকার সংস্থার চেয়ারম্যান পরিচয় দিয়েও শাহীরুল চাকুরী দেওয়ার নামে প্রতারণামূলক ভাবে অর্থ আত্মসাৎ করে এবং বিভিন্ন সময় মানুষকে ভয়ভীতি প্রদর্শন করে।
(গ) প্রতারণার কৌশল হিসেবে শাহীরুল “হোমল্যান্ড হাউজিং এন্ড ডেভলপমেন্ট কোঃ লিঃ” প্রতিষ্ঠা করে বেশ কয়েকজন মানুষকে ফ্ল্যাট ও প্লট প্রদানের কথা বলে বিপুল পরিমান অর্থ আত্মসাৎ করেছে বলে অনুসন্ধানে জানা যায়।
(ঘ) প্রতারণার কৌশল হিসেবে গ্রেফতারকৃত শাহীরুল “হোমল্যান্ড সিকিউরিটি এন্ড গার্ড সার্ভিসেস লিঃ”, “হোমল্যান্ড হাউজিং এন্ড ডেভলপমেন্ট কোঃ লিঃ”, “হোমল্যান্ড বেভারেজ এন্ড এগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ লিঃ” এবং “মাদারল্যান্ড সিকিউরিটি সার্ভিসেস লিঃ” প্রতিষ্ঠা করে।
(ঙ) শাহিরুল ইসলাম বাংলাদেশ আউট সোর্সিং এন্ড পাওয়ার সাপ্লাইয়ার্স এসোশিয়েশন এর সভাপতি হিসেবে জাহির করে অধিক ক্ষমতাধর ব্যক্তি হিসেবে পরিচয় প্রদানসহ অর্থ আত্মসাতের পর যাতে কেউ মুখ খুলতে না পারে সেজন্য ভয়ভীতি প্রদর্শন করে।
(চ) প্রতারক শাহীরুল বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ন ব্যাক্তিদের সাথে ছবি তুলে সেগুলো প্রদর্শনের মাধ্যমে নিজেকে অধিক ক্ষমতাধর ব্যক্তি হিসেবে জাহির করে এবং পাওনাদারদের হুমকি ধামকি প্রদর্শন করে।
মূল অভিযোগ সমূহ :
উক্ত প্রতিষ্ঠান সমূহের সকল কার্যক্রম অবৈধ ও প্রতারণামূলক।
হোমল্যান্ড সিকিউরিটি এন্ড গার্ড সার্ভিসেস লিঃ, হোমল্যান্ড হাউজিং এন্ড ডেভলপমেন্ট কোঃ লিঃ, হোমল্যান্ড বেভারেজ এন্ড এগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ লিঃ ও মাদারল্যান্ড সিকিউরিটি সার্ভিসেস লিঃ নামক প্রতিষ্ঠান সমূহের সরকার কর্তৃক অনুমোদিত নয়।
প্রতিষ্ঠানের নির্দিষ্ট কোন অফিসিয়াল সাইনবোর্ড নেই।
প্রতারনামূলকভাবে মানবাধিকার সংস্থার চেয়ারম্যান পরিচয়ে ভয়ভীতি প্রদর্শন করে।
সরকারী কর্মকর্তা না হয়েও ভূয়া পরিচয় প্রদান করে এবং সরকারী কর্মকর্তার সই স্বাক্ষর নকল করে।
বাংলাদেশ আউট সোর্সিং এন্ড পাওয়ার সাপ্লাইয়ার্স এসোশিয়েশন এর সভাপতি হিসেবে জাহির করে অধিক ক্ষমতাধর ব্যক্তি হিসেবে পরিচয় প্রদান করে।
অভিযান পরিচালনাকালে তার বাসা ও অফিস হতে দেশী-বিদেশী অস্ত্র ও প্রচুর পরিমান বুলেট পাওয়া গিয়েছে। এ সংক্রান্তে সে কোন বৈধ কাগজ পত্র প্রদর্শন করতে পারেনি। এছাড়া ভয়ভীতি প্রদর্শনের জন্য রক্ষিত ০৩ টি দামী পিস্তলও পাওয়া গিয়েছে।
গ্রেফতারকৃত আসামীর বিরুদ্ধে রামপুরা থানায় প্রতারনা এবং অস্ত্র আইনে পৃথক পৃথক মামলা রুজু প্রক্রিয়াধীন।