বিশেষ প্রতিবেদক :
দেশব্যাপী নির্যাতিত নারী ও শিশুদের সহায়তার জন্য মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় কর্তৃক চালিত নারী নির্যাতন প্রতিরোধকল্পে মাল্টিসেক্টরাল প্রোগ্রামের আওতায় নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ বিষয়ক কার্যক্রম ওয়ান-স্টপ ক্রাইসিস সেল(ওসিসি)। দেশের প্রায় প্রতিটি জেলা সদর হাসপাতাল এবং উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেল (ওসিসি) কার্যক্রম চলমান রয়েছে। নির্যাতনের শিকার হয়ে হাসপাতালে আগত নারী ও শিশুদের বিভিন্ন মাধ্যমে নানামুখী জরুরি সেবা দিয়ে যাচ্ছে ওসিসি। অসহায় নির্যাতিত নারী ও শিশুদের চিকিৎসা সহায়তা, আইনী সহায়তা, পুলিশী সহায়তা, মনোসামাজিক কাউন্সেলিং সহায়তা, পারিবারিক বিরোধ নিরসনে সালিশী বা মধ্যস্থতা সহায়তা, জীবিকা নির্বাহে প্রশিক্ষণ সহায়তা, পুনর্বাসন সহায়তা, ডিএনএ পরীক্ষা সংক্রান্ত তথ্য ও করণীয় ইত্যাদি বিষয়ে সেবা প্রদান করছে।
এ সেবা কার্যক্রম শেরপুরে চালু হওয়ায় নির্যাতনের শিকার নারী ও শিশুদের সেবাপ্রাপ্তি এখন পুরোপুরি নিশ্চিত হয়েছে। নির্যাতনের শিকার হওয়া নারী ও শিশুদের বিভিন্ন সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে শেরপুর জেলার ওয়ান-স্টপ ক্রাইসিস সেল (ওসিসি) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে।
ঘটনাসূত্রে জানা যায়, কিছুদিন আগে জাতীয় হেল্পলাইন নাম্বার ১০৯ থেকে ওসিসি’র কাছে ফোন আসে শেরপুর সদর উপজেলার চর-সাহাব্দী তে ৭ম শ্রেণিতে পড়ুয়া এক ছাত্রীর বিয়ে হবে সন্ধ্যা ৭ টায়। খবর পেয়ে দুপুরেই উপজেলা প্রশাসন, জেলা পুলিশ এবং ওসিসি’র যৌথ অভিযান পরিচালনা করা হয়। এলাকার চেয়ারম্যানের উপস্থিতিতে দুই পরিবারের মধ্যে লিখিত মুচলেকা নিয়ে বিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়।
এছাড়া কিছুদিন আগে শেরপুর সদরে ৮ম শ্রেণিতে পড়ুয়া তেরো বছর বয়সী এক ছাত্রী শ্লীলতাহানির শিকার হয়ে ওসিসি’তে আসেন সুষ্ঠু বিচারের আশায়। স্কুলে যাবার পথে একা পেয়ে এলাকার কয়েকজন যুবক তাকে শ্লীলতাহানির চেষ্টা করে।
এ অবস্থায় এক আত্মীয়ের কাছে ওই স্কুল ছাত্রী জানতে পারেন জেলা ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেল (ওসিসি) শেরপুরের কথা। সেই স্কুল ছাত্রীর পরিবার ওসিসি’তে গিয়ে আইনগত সাহায্যের আবেদন করেন। জেলা সদর হাসপাতালের ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেলের (ওসিসি) প্রোগ্রাম অফিসার অমিত শাহরিয়ার বাপ্পী, ঐ স্কুল ছাত্রীর পক্ষে মামলা লড়তে ওই তাৎক্ষণিক জেলা লিগ্যাল এইডের সহায়তায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্হা গ্রহণ করেন। নারী ও শিশু নির্যাতনের এই মামলায় সেই স্কুল ছাত্রীর পক্ষে রায় হওয়ার পর মামলায় পলাতক আসামীকে ময়মনসিংহ থেকে আটক করে শাস্তি প্রদান করা হয়।
জানতে চাইলে ওই স্কুল ছাত্রী বলেন, ‘মামলা চালাতে আমাদের কোনো টাকা-পয়সা খরচ হয়নি। অপরাধীরা উপযুক্ত শাস্তি পেয়েছে। ওসিসি-শেরপুর আমাকে অনেক সাহায্য করেছে এজন্য আমি ওসিসি-শেরপুর কে ধন্যবাদ জানাই।
এমন অনেক আর্থিক অসচ্ছল ভুক্তভোগীদের বিনামূল্যে সমাজসেবা কার্যক্রম, মনোসামাজিক কাউন্সেলিং, পুলিশী সেবা, ফরেনসিক ডিএনএ পরীক্ষা, আইনি সেবা, পুনর্বাসন কার্যক্রম, নিরাপদ আশ্রয়, সমাজে পুনঃএকত্রীকরণ সেবাসমূহ দিয়ে যাচ্ছে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ কার্যক্রম ওয়ান-স্টপ ক্রাইসিস সেল (ওসিসি) জেলা হাসপাতাল শেরপুর।
এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, করোনা মহামারীর শুরু থেকে চলমান সময়েও থেমে নেই ওসিসি সেবার কার্যক্রম। বিগত দেড় বছরে সরাসরি মামলার জন্য মোট আবেদন পড়েছে ৩৪৫ টি, মোট মামলা নিষ্পত্তি ৬৫ টি, বিকল্প পদ্ধতিতে সফল নিষ্পত্তি ২৮৩ টি, নথিজাত আছে ৮৩ টি, অপেক্ষামান ১০৩ টি, পরামর্শ প্রদান করা হয় ৭৪২ জনকে এবং এডিআর এর ফলে বিচারাধীন বা চলমান মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে ২৪২ টি ।
এর মধ্যে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয় ১৫৬ জন নারী ও শিশু , নারী ও শিশু ধর্ষণ ৮২ টি, মানসিক ১০৫ টি, বার্ণ ২ টি।
জেলা সদর হাসপাতালের ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেল (ওসিসি)’র প্রোগ্রাম অফিসার অমিত শাহরিয়ার বাপ্পী জানান, মানুষ এখন নিজের অধিকার সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন। জেলা প্রশাসন, জেলা পুলিশ, উপজেলা প্রশাসন, জেলা মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর, জাতীয় মহিলা সংস্থা, জেলা লিগ্যাল এইড অফিস, সরকারী-বেসরকারী বিভিন্ন এনজিও সংস্থা সহ সংশ্লিষ্ট সকলের সম্মিলিত সহযোগিতায় এগিয়ে যাচ্ছে জেলা ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেল শেরপুরের কার্যক্রম। বিনামূল্যে ওসিসি’র সেবা প্রদান কার্যক্রম চালু হওয়ায় বিচারপ্রার্থী অসহায় নির্যাতিত জনগনের মাঝে দ্রুত সময়ে ন্যায়বিচার প্রাপ্তিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে ওসিসি।
এ ব্যাপারে জেলা হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ও সিভিল সার্জন ডা. এ কে এম আনওয়ারুর রউফ বলেন, নির্যাতনে শিকার নারী ও শিশুদের ওসিসি সেবা জোরদার করার জন্য হাসপাতালে স্থাপিত হয়েছে ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেল। বিভিন্নভাবে নির্যাতিত হয়ে আসা নারী ও শিশুদের মানসিক অবস্থার উন্নতির জন্য স্বাস্থ্য সেবা ও আইনি সহায়তার পাশাপাশি ওসিসি’তে মানসিক কাউন্সিলিং’এর ব্যাবস্থাও চালু রয়েছে।
জেলা মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর এর উপ -পরিচালক মোঃ লুৎফুল কবীর বলেন, নারী ও শিশু নির্যাতনের জটিল বিষয়গুলো লিগ্যাল এইডের জন্য শেরপুর ওসিসি’র মাধ্যমে আইনগত সহায়তার জন্য কোর্টে প্রেরণ করা হয়। আমরা অনেক নারী নির্যাতন সংক্রান্ত সমস্যার আবেদন আমাদের অফিসে বসে সমাধান করি। তবে যে গুলো সমাধান করা সম্ভব হয় না কিংবা চিকিৎসা সেবা,কাউন্সেলিং সেবা অথবা আইনগত সহায়তার প্রয়োজন হয় সেসব ক্ষেত্রে সমাধানের জন্য ওসিসিতে প্রেরণ করে থাকি। শেরপুর সেলের কার্যক্রম খুবই প্রশংসনীয়। যদি ওসিসি’র কার্যক্রম দেশের সকল জেলা ও উপজেলায় সম্প্রসারণ করা যায় তাহলে আরও অনেক নির্যাতিত নারী ও শিশু উপকৃত হবে আশা করা যায়।
নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে যোগাযোগ ও আইনগত সহায়তার জন্য জাতীয় হেল্পলাইন ১০৯ নাম্বার ও ওসিসি সমন্বয় করে কাজ করে চলেছে। টোল ফ্রি ১০৯ নাম্বারটি সপ্তাহে ৭দিন ২৪ ঘন্টা সেবা প্রদান করে যাচ্ছে।