ভবিষ্যত না ভেবে বন্ধু চীনের বিপদে সবকিছু করি, চীন-পাকিস্তান অটুট বন্ধুত্বের নেপথ্যে

আন্তর্জাতিক

আন্তর্জাতিক ডেস্ক :
চীন ও পাকিস্তান ভ্রাতৃপ্রতিম প্রতিবেশী এবং সব পরিস্থিতিতেই কৌশলগত সহযোগী অংশীদার। চীনারা পাকিস্তানকে ‘আয়রন পাক’ বলে যার অর্থ চীন-পাকিস্তান বন্ধুত্ব লোহার মতো মজবুত। দুই দেশ ১৯৫১ সালে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে। পরবর্তী ৭০ বছরে বেশ কয়েকটি প্রজন্মের নেতাদের ব্যক্তিগত প্রতিশ্রুতি এবং উভয় দেশের জনগণের আন্তরিক সমর্থনের কারণে চীন ও পাকিস্তান এক অটুট বন্ধুত্ব গড়ে তুলেছে।

চীন ও পাকিস্তানের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্কের ৭০ বছর পূর্তি উপলক্ষে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম মুখপাত্র বলে পরিচিত গ্লোবাল টাইমস এর এক নিবন্ধে এমন মন্তব্য করা হয়েছে। নিবন্ধে ১৯৬০ এর দশকে দুই দেশের একসাথে কারাকোরাম হাইওয়ের নির্মাণকাজে হাত দেয়া থেকে শুরু করে ভুট্টোর চীন সফর, ওয়েনচুয়ানের ভূমিকম্প, পাকিস্তানের বন্যা, শি জিনপিং এর পাকিস্তান সফর, হালে করোনার বিরুদ্ধে লড়াই এর উদাহরণ টেনে দুই দেশের সুসম্পর্কের বিস্তারিত বর্ণনা করা হয়েছে।

কারাকোরাম হাইওয়ের ইতিহাস সম্পর্কে এতে বলা হয়েছেঃ ১৯৬০ এর দশকে, তৎকালীন পাকিস্তানি প্রেসিডেন্ট প্রাচীন সিল্ক রোড ধরে একটি মহাসড়ক তৈরিতে চীনের সহায়তা চাওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করার জন্য বেইজিংয়ে তার একজন রাজনৈতিক উপদেষ্টাকে পাঠান। চেয়ারম্যান মাও সেতুং এবং প্রধানমন্ত্রী চৌ এনলাই কোন দ্বিধা ছাড়াই একমত হন যে, চীন পাকিস্তানের সাথে একত্রে এটি করবে। এখন যেটিকে সবাই কারাকোরাম হাইওয়ে হিসেবে চেনেন। এটি ১,২২৪ কিলোমিটার দীর্ঘ যার ৬০০ কিলোমিটারেরও বেশি পাকিস্তানে পড়েছে।
চীনের সহায়তায় পাকিস্তান এটি নির্মাণ করে। এটি দুই দেশের মধ্য দিয়ে যাওয়া একমাত্র স্থলপথ। এটি হিমালয়, কারাকোরাম, হিন্দুকুশ এবং পামির মালভূমির ভেতর দিয়ে গেছে।

এই অঞ্চলের আবহাওয়া খুব খারাপ ছিল, অক্সিজেনের ঘাটতি ছিল; জলাবদ্ধতা ও ভূমিকম্প ছিল স্বাভাবিক ঘটনা। তবে এগুলোর কোনকিছুই ‘বীরত্বপূর্ণ’ ওই কাজে নির্মাণকর্মীদের আটকাতে পারেনি। তাদের একজন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে শূন্যে ঝুলে ঝুলে কাজ করার স্মৃতিচারণ করছিলেন- তারা নিরাপত্তা দড়ির এক প্রান্ত তাদের কোমরে বেঁধে রাখতেন এবং খাড়া পাহাড়ে উঠে দড়ির অন্যপ্রান্ত বাঁধার জন্য কোন শিলাপাথর বা গাছের সন্ধান করতেন। তারা পাথরে ছিদ্র করার জন্য ‘পন্ডেরাস নিউমেটিক ড্রিল’ বহন করতেন এবং পাথরে ডিনামাইট বিস্ফোরণ করে যাতায়াতের জায়গা প্রস্তুত করতেন। এগুলো সব তারা শূন্যে ঝুলে ঝুলে করতেন। কষ্ট ও বিপদের মাত্রা ছিল অস্বভাবিক। তারা প্রায়ই পানি পান বা কোন বিরতি ছাড়াই ঘন্টার পর ঘন্টা কাজ করতেন এবং সারাক্ষণ নজরে রাখতেন কোন পাথর গড়িয়ে পড়লো কিনা।

এমন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ মনোভাব নিয়েই চীন ও পাকিস্তানের নির্মাণকর্মীরা হিমশীতল এক মালভূমি থেকে বন্ধুত্বের এক মহাসড়ক তৈরি করেছিলেন। অনেক চীনা শ্রমিক ওই নির্মাণকাজ করতে গিয়ে প্রাণ দিয়েছিলেন। ৮৮ জন চীনা নির্মাণ শ্রমিককে ‘গিলগিট চাইনিজ মেমোরিয়াল’ কবরস্থানে সমাহিত করা হয়েছে যাদের ঘাম এবং জীবন দিয়ে নির্মিত হয়েছে ওই হাইওয়ে এবং চিরস্থায়ী চীন-পাকিস্তান বন্ধুত্ব।

১৯৭৬ সালের মে মাসে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোর চীন সফর সম্পর্কে গ্লোবাল টাইমসের ওই নিবন্ধে বলা হয়েছে-

ওই সময়, চেয়ারম্যান মাও সেতুং ছিলেন জীবন সায়াহ্নে, তার কথা বলতে এবং হাঁটাচলা করতে অসুবিধা হতো। তা সত্ত্বেও, তিনি ২৭ শে মে তার বাসভবনে পাকিস্তানি অতিথিদের সাথে দেখা করতে রাজি হয়েছিলেন এবং ভুট্টোর কাছে পাকিস্তানের উন্নয়নের বিষয়ে জানতে চেয়েছিলেন। সেটাই ছিল বিদেশী কোন অতিথির সাথে তার শেষ দেখা করা। মাওয়ের মৃত্যুর পর তার গৃহীত উদ্যোগগুলো তার উত্তরসূরীরা এগিয়ে নিয়ে যান এবং চীন-পাকিস্তান বন্ধুত্ব আরও দৃঢ় হয়।

২০০৮ সালে চীনের ওয়েনচুয়ানের ভয়াবহ ভূমিকম্প এবং ২০১০ সালে পাকিস্তানের ব্যাপক বন্যায় দুদেশের একে অপরকে সহযোগিতার কথা স্মরণ করে গ্লোবাল টাইমস লিখেছে-

২০০৮ সালে যখন দক্ষিণ-পশ্চিম চীনের ওয়েনচুয়ান ভয়াবহ ভূমিকম্পের কবলে পড়ে, তখন পাকিস্তান সাহায্যের জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করে। কৌশলগতভাবে রিজার্ভে থাকা সব তাঁবু চীনে প্রেরণের জন্য দেশটি তার সব সামরিক পরিবহণ বিমানকে তাত্‍ক্ষণিকভাবে মোতায়েন করে। পাকিস্তানি কর্মীরা এমনকি বিমানের সব আসন সরিয়ে ফেলে মেঝেতে বসে পড়ে যাতে আরও বেশি সংখ্যক তাঁবু সরবরাহ করা যায়। পাকিস্তানের জন্য সেগুলোর ব্যয় বহন করা সামান্য কিছু ছিল না। ইসলামাবাদের চীনা দূতাবাস একাধিকবার ওই তাঁবুগুলোর জন্য অর্থ প্রদানের আগ্রহ প্রকাশ করে। তবে পাকিস্তানের জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যানসহ পাকিস্তানি কর্মকর্তারা কখনোই কোনো মূল্য জানান নি। তারা শুধু বলেছিলেন, পাকিস্তান-চীন বন্ধুত্ব অর্থ দিয়ে পরিমাপ করা যায় না।

২০১০ সালে, পাকিস্তানে যখন ব্যাপক বন্যা হয় চীন তখন বিমান ও স্থলপথে পাকিস্তানকে সহায়তা পাঠিয়ে দ্রুত সাহায্যের প্রস্তাব দেয়। চীন তার বৈদেশিক সাহায্যের ইতিহাসে বৃহত্তম মেডিকেল উদ্ধারকারী দল প্রেরণ করেছিল এবং পাকিস্তানকে সহায়তার জন্য প্রথমবারের মতো তার বড় আকারের যানবাহন এবং হেলিকপ্টারের বহর বিদেশে প্রেরণ করে। ২০১৫ সালে ইয়েমেন সঙ্কটের সময়, চীনা নৌবাহিনীর ফ্রিগেট লিনয়ি এডেন উপসাগর থেকে ১০ টি দেশের ২২৫ জন নাগরিককে সরিয়ে নিয়েছিল, যাদের মধ্যে ১৭৬ জন ছিল পাকিস্তানি নাগরিক। কথায় আছে,
“ভাগ করে নেয়া আনন্দ দ্বিগুণ হয়, ভাগ করে নেয়া শোক অর্ধেক হয়ে যায়।” এই উক্তিটি চীন ও পাকিস্তানের মধ্যকার দীর্ঘদিনের ভ্রাতৃত্বের নিখুঁত চিত্রণ।

গ্লোবাল টাইমসের মতে, চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর হলো বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) প্রধান পাইলট প্রোগ্রাম। এতে বলা হয়েছে-

আজ, চীন-পাকিস্তানের অটুট বন্ধুত্ব যেকোন সময়ের চেয়ে বেশি শক্তিশালী, নতুন যুগে তা আরও বেশি তাৎপর্য অর্জন করেছে। ২০১৫ সালে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং পাকিস্তানে এক ঐতিহাসিক সফরের মাধ্যমে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে সব পরিস্থিতিতে কৌশলগত সহযোগিতার অংশীদারিত্বের দিকে উন্নীত করেন এবং সম্পর্কের নতুন অধ্যায় উন্মোচন করেন। এবার আসা যাক অর্থনৈতিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে। চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর হলো বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) প্রধান পাইলট প্রোগ্রাম এবং দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতার ডেমন্সট্রেশন প্রজেক্ট।

করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে দুই দেশ একসাথে লড়ছে উল্লেখ করে গ্লোবাল টাইমস লিখেছে-

করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধেও দুই দেশ একসাথে লড়ছে। চীন যখন করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সবচেয়ে কঠিন পর্যায়ে তখন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আরিফ আলভি (২০২০ সালের ১৬-১৭ মার্চ) চীনের প্রতি পাকিস্তানের সমর্থন জানাতে চীন সফর করেন। সিজিটিএন-কে দেয়া তার সাক্ষাৎকারটি হৃদয় ছুঁয়ে যায়: করোনা আঘাত হানার সময় আমরা চীনকে সমস্ত কিছু পাঠিয়েছিলাম। এটাই বন্ধুর কাজ। ভবিষ্যতে কী ঘটবে তা নিয়ে আমরা চিন্তাই করিনি কারণ আমাদের বন্ধুরা ভুগছে। মহামারী যখন পাকিস্তানকে আঘাত করে, তখন চীন একই মনোভাব নিয়ে এগিয়ে যায়। অস্থায়ী কোয়ারেন্টাইন হাসপাতালগুলোতে অর্থায়ন করা, চিকিৎসা বিশেষজ্ঞ দল পাঠানো এবং অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করে নেওয়া সহ পাকিস্তানকে যথেষ্ট সহায়তা করেছিল। ২০২১ সালের ০১ ফেব্রুয়ারী, বিদেশে অনুদান হিসেবে দেয়া চীনা সরকারের করোনা ভ্যাকসিনের প্রথম চালান ইসলামাবাদে পৌঁছে। ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করতে দু’দেশের একসাথে দাঁড়ানোর অনেক মর্মস্পর্শী গল্প রয়েছে।

সত্যিকারের বন্ধুত্ব সবসময়ই সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ। পাকিস্তানের জনগণ চীনের সাথে এই বন্ধুত্বকে “পাহাড়ের চেয়ে উঁচু, সমুদ্রের চেয়ে গভীর এবং মধুর চেয়েও মিষ্টি” বলে মনে করে। চীনা জনগণ পাকিস্তানকে “ভালো বন্ধু, ভালো প্রতিবেশী, ভালো অংশীদার এবং ভালো ভাই” হিসেবে দেখে। ২০২১ সালে চীন ও পাকিস্তানের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্কের ৭০ বছর পূর্তি। ‘দুঃসময়ের বন্ধু’ থেকে ‘সাধারণ উন্নয়নের বন্ধু’তে পরিণত হওয়া দুই দেশ বিগত সাত দশকে সর্বদা একে অপরকে বুঝতে পেরেছে এবং সমর্থন করেছে, যা এক রাষ্ট্রের সাথে অন্য রাষ্ট্রের সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি ভাল উদাহরণ স্থাপন করেছে। পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ একবার বলেছিলেন আমরা গভীর সমুদ্র কিংবা আগুনে ভয় পাই না, কারণ আমরা সূর্য এবং ভবিষ্যতে বিশ্বাসী। চীন-পাকিস্তান সম্পর্কের ক্ষেত্রে আমরা অবশ্যই আরও উজ্জ্বল ভবিষ্যত এবং উভয় দেশের বৃহত্তর উন্নয়নে বিশ্বাসী।

Leave a Reply

Your email address will not be published.