বিশেষ প্রতিবেদন :
গ্রামাঞ্চলের একটা কথা বলে, ‘যে লাউ, সেই কদু’। অর্থাৎ যা ভেবেছিলাম, তাই হলো। আশার চাঁদ আশায়-ই রইলো। মাঝখানে চাঁদ ছোব ছোব বলে আর হলো না, সেই দুরাশাই থেকে গেল। আসলে মফস্বল সাংবাদিকদের যে কপাল ভালো না, তা ডিইউজে ও বিএফইউজে কর্তৃক মাননীয় তথ্যমন্ত্রীর হাতে ৫হাজার ৭৭১ সাংবাদিকের তালিকা প্রণয়ন খবর দেখলেই বোঝা যায়।
বিশ্বজুড়ে মহামারি করোনা ভাইরাসে মোকাবিলায় সরকার প্রধান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একে একে নিয়েছেন প্রশংসনীয় উদ্যোগ। কিন্তু সে উদ্যোগ যথাপূর্ণভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে না অসৎ কিছু মানুষদের কারণে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু স্বাধীন দেশের রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের সেই সাড়ে সাত কোটি মানুষের কম্বল থেকে নিজের জন্য কম্বল না থাকার আক্ষেপটা মনে পড়ে গেল। ‘লোকে পায় সোনার খনি, আর আমরা পাই চোরের খনি।’ যা করোনা প্রাদুর্ভাব সরকারের গৃহিত পদক্ষেপের চাল-ডাল-তেল চুরির ঘটনা দেখে। যায় হোক, সে প্রসঙ্গে যাচ্ছি না।
মফস্বল সংবাদকর্মী ছাড়া যে সংবাদমাধ্যম কতোটা অচল তা হয়তো মনে মনে স্বীকার করলেও উনারা প্রকাশ্যে স্বীকার করতে চান না। কারণ কি, স্বার্থ সিদ্ধ হয় না। যত পারো, বঞ্চিত রেখে নিজেরা লাভবান হও। রাজধানীর আবাসন সুবিধা, বিলাসবহুল জীবনের আরাম-ভোগ করার তো প্রচুর অর্থের প্রয়োজন হয়। এ কারণে নিচতলার দিকে না তাকিয়ে যতটা উপরতলার সিড়ি বাড়ানো যায় সে চেষ্টা থাকে উনাদের।
বিশ্বজুড়ে মহামারিভাবে ছড়িয়ে পড়া করোনা পাদুর্ভাবকে মোকাবেলা করতে সরকার ইতিমধ্যে সবাইকে প্রণোদনা প্রদান করেছেন। কারণ, যাতে কেউ দুর্ভোগে পড়ে ভেঙ্গে না পড়ে। না খেয়ে থাকে। কর্মচাঞ্চল্য থাকে। কৃষক যাতে এই দুর্যোগের মধ্যে ফসল ফলাতে পারে, সেজন্য ৫ হাজার কোটি ভুতুর্কি প্রণোদনা করেছেন। ঘরবন্দি মানুষদের জন্য খাবার পৌছে দিচ্ছেন।
সবারই যখন হলো, তখন এ প্রণোদনা থেকে বাদ পড়লো গণমাধ্যম/সংবাদমাধ্যম কর্মীরা। মহামারি এ দুর্যোগের কারণে ঝুকি নিয়ে মাঠে থেকে তথ্য সংগ্রহ করা এ সংবাদকর্মীদের জন্য কিছু করতে বললেন আমাদের গণমাধ্যমের নেতা মহোদয়রা। আমরা তো তাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকি। ভরসা করি। কিছু একটা হলে আমরাও তো সেটার অংশীদার হব। অন্যায় হলে প্রতিবাদ করি। করোনার এ উদ্ভট পরিস্থিতিতে দেশের সংবাদমাধ্যমের মফস্বল সংবাদকর্মীদের নিয়ে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, সেটার শুরুর বিষয়টি আশার আলো দেখিয়েছিল। ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন (ডিইউজে)। সাংবাদিকদের জন্য রেশনিং ব্যবস্থা চালুর দাবির বিষয়টি আমাদের আশা তৈরি করেছিল।
পেশাগত দায়িত্ব পালন কঠিন চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়ে থাকা সাংবাদিকদের জন্য প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি রেশনিং ব্যবস্থা প্রবর্তনের কথাটি দেশের প্রতিটি কর্মরত সংবাদকর্মীদের বুকে একটা আস্থা সঞ্চার করেছিল। মনে হয়েছিল, এ কঠিন পরিস্থিতিতে তাহলে সাংবাদিকদের জন্য কিছু করা হচ্ছে।
এর থেকে আরেকটি সুখবর চোখে পড়লো যখন দেখলাম, বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল দেশের সকল জেলার প্রশাসকের কাছে কর্মরত সাংবাদিকদের তালিকা করে পাঠানোর নির্দেশ পত্র। এ নির্দেশপত্র দেখে দেশের সকল মফস্বল সংবাদকর্মীরা দূর্ভোগে থেকেও কষ্ট নিয়েও আশার হাসি দিয়েছিলেন।
যখন দেখলাম মাননীয় তথ্যমন্ত্রীর হাতে পৌছানো হয়েছে মাত্র ৫ হাজার ৭৭১ সাংবাদিকের তালিকা। তখন সেই উদিত হাসি নিভে গেছে ঝরা ফুলের মতো। তালিকা অনুযায়ী, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের (ডিইউজে) ৩ হাজার ১৬০, চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়নের (সিইউজে) ৪০২, খুলনা সাংবাদিক ইউনিয়নের (কেইউজে) ১১৪, রাজশাহী সাংবাদিক ইউনিয়নের (আরইউজে) ৩৮, ময়মনসিংহ সাংবাদিক ইউনিয়নের (এমইউজে) ৬৬, যশোর সাংবাদিক ইউনিয়নের (জেইউজে) ৭৬, বগুড়া সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিইউজে) ৬৮, কক্সবাজার সাংবাদিক ইউনিয়নের (সিবিইউজে) ৭৬, নারায়ণগঞ্জ সাংবাদিক ইউনিয়নের (এনইউজে) ৪৬, কুষ্টিয়া সাংবাদিক ইউনিয়নের (জেইউকে) ৭৬ এবং বরিশাল সাংবাদিক ইউনিয়নের (জেইউবি) ৫৯ জন রয়েছেন।
এছাড়া সব জেলার মূলধারার গড়ে ৩০ সংবাদকর্মী করে ৫৩ জেলায় মোট এক হাজার ৫৯০ জন, যা সব মিলিয়ে ৫ হাজার ৭৭১ জন সাংবাদিকের তালিকা হস্তান্তর করা হয়েছে। এখানে খটকা তৈরি হয়েছে। প্রশ্ন জেগেছে, হতাশা তৈরি হয়েছে। বঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কাও তৈরি হয়েছে। ৫৩ জেলায় মাত্র ১ হাজার ৫৯০ জন সংবাদকর্মী।
মনে হচ্ছে, ঘরে বসে কল্পনা করেই মনগড়াভাবে তৈরি করা হয়েছে এ তালিকা। তাছাড়া ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের ধরে নিলাম ১১টি শাখা রয়েছে। এখানে তো দেশের ৬৪টি জেলাতেই প্রেসক্লাব, রিপোর্টার্স ইউনিটির মতো অনেক সংগঠন রয়েছে। তাদের তালিকা কোথায়?
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যে সাংবাদিক বান্ধব; তাতে কোনো সন্দেহ নেই। হয়তো তিনি দেরিতে সাংবাদিকদের প্রণোদনা দিতে দেরিতে ঘোষণা দিয়েছেন। এতেও সাংবাদিকদের ধৈর্য পরীক্ষা নিয়েছেন। সবচেয়ে ভালো হতো, প্রেস কাউন্সিলের মাধ্যমে দেশের সব জেলা প্রশাসককে চিঠি দিয়ে সাংবাদিকদের তালিকা প্রস্তুত করে পাঠানো হলে। তাহলে এই দুর্যোগ মুহুর্তে এ প্রণোদনা আর্থিক সহযোগিতা হতে মফস্বল সংবাদকর্মীদের বঞ্চিত হবার আশঙ্কা তৈরি হতো না।
প্রেস কাউন্সিলের চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, “জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে সাংবাদিক ও সংবাদসংশ্লিষ্ট কর্মীরা করোনাভাইরাসের ঝুঁকি নিয়ে জরুরি তথ্য জানানোর জন্য জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে কাজ করছে। তাই তাদের জন্যও প্রণোদনা প্রয়োজন। এমতাবস্থায় আপনার জেলায় প্রেস ক্লাব ও সাংবাদিক সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে সাংবাদিক ও সংশ্লিষ্টদের তালিকাভুক্ত করে প্রণোদনার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বিশেষভাবে অনুরোধ করা হলো।”সংবাদকর্মীদের প্রণোদনা দিতে প্রেস কাউন্সিলের এ চিঠি দেশের সকল সাংবাদিকসহ মফস্বল সংবাদকর্মীদেরও আশা সঞ্চার করেছে।
সোস্যাল নেটওয়ার্ক ফেসবুকে এ চিঠির হাজারো মন্তব্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে অভিবাদন জানানো হয়েছে। একটি পরিসংখ্যান দেখানো যেতে পারে, দেশের ৬৪টি জেলা শহরেই ৩০-৩৫ জন সংবাদকর্মী রয়েছে। আর প্রতিটি জেলার উপজেলাগুলোতে ২০-৩০ জন সংবাদকর্মী রয়েছে। তাহলে দেশের ৬৪টি জেলার ৪৯২টি উপজেলা রয়েছে। প্রতিটি উপজেলাতেই বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে কর্মরত সংবাদকর্মী রয়েছে। সেখানে ৫৩টি জেলার মাত্র ১ হাজার ৫৯০ জনের সংবাদকর্মীর তালিকা তথ্যমন্ত্রীর হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে।
আর শোনা যাচ্ছে, এ তালিকা অনুযায়ী মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আর্থিক অনুদান হিসেবে বুধবার বাংলাদেশ সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্ট বরাবরে ২০ কোটি টাকার চেক প্রদান করা হয়েছে। এটা অত্যন্ত আনন্দের সংবাদ। কিন্তু আর্থিক প্রণোদনার প্যাকেজে যতদূর মনে হচ্ছে মুষ্টিময় উপকারভোগীদের সুবিধা ভোগ করবেন।
সর্বোপরী আমাদের সাংবাদিকদের আস্থার প্রতীক নেতৃবৃন্দের প্রতি বিষয়টি আবার পর্যালোচনা করার অনুরোধ করছি। বিশ্বের এ ক্রান্তিকালে যদি মফস্বল কোন সংবাদকর্মী বঞ্চিত থেকে কোনো ক্রমে না খেয়ে, অবহেলায় জীবন-যাপন করে তাহলে এটা দেখার দায়িত্ব কার?
এ মুক্তপ্রসঙ্গ নিবন্ধ আপনাদের কোনো হেয়-প্রতিপন্ন করার মতো সাহস আমার নেই। শুধু বিশ্ব বিপর্যয়ের মুহুর্তে দেশের মফস্বল সংবাদকর্মীরা যাতে দূর্ভোগে পরে অর্থ ও খাদ্য সংকটে পরে বিপন্ন জীবনযাপন না করে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকন্যা মানবতার মমতাময়ী মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতি সে বিষয়টি নজর দিতে অনুরোধ করছি।
লেখকঃ ফুয়াদ মোহাম্মদ সবুজ
গনমাধ্যমকর্মী, চট্টগ্রাম